রাজনৈতিক বিরোধ মেটাতে বিদ্যমান দুই পক্ষ মুখোমুখি আলোচনায় বসেছে, হঠাৎ একপক্ষের মানুষজন অন্যদের জানালা থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলে গোটা ব্যাপারটা কেমন হবে? ঠিক এরকম ঘটনা ঘটেছিল সপ্তদশ শতকের প্রথমদিকের ইউরোপে। যদিও যাদের তিন তলা ওপর থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তারা সৌভাগ্যক্রমে গিয়ে পড়েছিল গোবরের গাদার ওপর, তাই প্রাণে বেঁচে যান। তারপর পড়িমড়ি করে দৌড় নিজের রাজ্যের উদ্দেশ্যে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩০ বছর ব্যাপী ভয়ঙ্কর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তৎকালীন ইউরোপ। সেই যুদ্ধে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক পুরুষ মারা যান।
জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলার এই ঘটনাটি ‘দ্য থার্ড ডিফেনেস্ট্রেশন’ নামে পরিচিত। ঘটনাটি ঘটেছিল তৎকালীন হোলি রোমান এম্পায়ারের অন্যতম প্রধান ক্ষমতার কেন্দ্র প্রাগে। খ্রিস্টান ধর্মের দুই শাখা রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে বিরোধ মেটাতে গিয়ে একদল ক্যাথলিক রাজপ্রতিনিধিকে প্রাগের সংসদ সদস্যরা দুর্গের তৃতীয় তলার জানালা থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
ডিফেনেস্ট্রেশন শব্দটির অর্থ হল জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। কিন্তু মধ্যযুগের ইউরোপে মূলত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এক পক্ষ অপর পক্ষকে জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো বেশ কিছু ঘটনার নজির আছে। এই প্রাগ শহরেই এই ঘটনাটির আগে আরও দুবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আলোচনা চলাকালীন জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে মধ্যযুগে ইউরোপে হোলি রোমান এম্পায়ার নামে একটি রাষ্ট্র জোট গড়ে উঠেছিল। এটা ঠিক এক রাজার অধীন কোনো রাজ্য ছিল না, বরং বেশ কিছু বৃহৎ ও শক্তিশালী রাজ্যের পাশাপাশি অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য নিয়ে হোলি রোমান এম্পায়ার গড়ে ওঠে। বর্তমান জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ইতালি, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সের কিছু অংশ নিয়ে তৎকালীন এই রাষ্ট্র জোট গড়ে উঠেছিল। হোলি রোমান এম্পায়ারের অন্তর্গত রাষ্ট্রগুলি এক ধরনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে সম্রাট অর্থাৎ রাষ্ট্র জোটের প্রধানকে নির্বাচিত করত। যে রাজ্যের রাজা সম্রাট হিসেবে নির্বাচিত হতেন সেই রাজ্যের রাজধানী সেই সময় হোলি রোমান এম্পায়ারের রাজধানী হিসেবে পরিগণিত হত এবং সংসদ-টিও সেখানেই স্থানান্তরিত হত। এই রাষ্ট্র জোটের মধ্যে শক্তিশালী রাজ্যগুলি ছিল প্রাশিয়া, বোহেমিয়া, বার্গান্ডি, স্যাক্সন, অস্ট্রিয়া, ব্যাভেরিয়া, নরম্যান্ডি, মিলান ইত্যাদি।
১৪৩৭-১৮০৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় জুড়ে হোলি রোমান এম্পায়ারের নেতৃত্ব ছিল অস্ট্রেলিয়ান রাজপরিবার হ্যাসবার্গদের ওপর। মাঝের ১৭৪১-৪৫ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য কেবলমাত্র এই কর্তৃত্ব অস্ট্রেলিয়ান রাজপরিবারের হাতছাড়া হয়। ইতিমধ্যেই মার্টিন লুথার ভ্যাটিকানের পোপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে খ্রিস্টান ধর্মের নতুন শাখা প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদের প্রচলন করেন। হোলি রোমান এম্পায়ারের অন্তর্গত রাজ্যগুলির রাজন্যবর্গের একাংশ প্রোটেস্ট্যান্ট ভাবধারার অনুগামী হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই জনগণের একাংশ প্রোটেস্ট্যান্ট মতে আস্থাশীল হন।
খ্রিস্টান ধর্মের দুই শাখা হলেও ষোড়শ ও সপ্তদশ শতক জুড়ে ইউরোপে ক্যাথলিকদের সঙ্গে প্রটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে হোলি রোমান এম্পায়ারের সম্রাট পঞ্চম চার্লস ১৫৫৫ সালে অসবার্গ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তি মোতাবেক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত প্রতিটি রাজ্য ও রাজারা তাদের ইচ্ছেমতো ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা লাভ করে। ঐতিহাসিকদের মতে অসবার্গ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।
পঞ্চম চার্লস, ম্যাথিয়াসের পর হোলি রোমান এম্পায়ারের সম্রাট হন অস্ট্রেলিয়ান রাজপরিবারের সদস্য ফার্দিনান্দ। তিনি ছিলেন একজন গোঁড়া ক্যাথলিক। খুব দ্রুত সাম্রাজ্যের প্রোটেস্ট্যান্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী রাজ্যগুলির সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সাম্রাজ্যের সরকারি জমির ওপর প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ম্যাথিয়াস।বোহেমিয়ার প্রোটেস্ট্যান্ট রাজা ও সংসদ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে সম্রাট ফার্দিনান্দ সেই সংসদ বাতিল পর্যন্ত করে দেন।
যাবতীয় সমস্যার নিরসন করার ১৬১৮ সালের ২৩ মে সম্রাট ফার্দিনান্দ চারজন প্রতিনিধিকে প্রাগে পাঠান বাতিল প্রোটেস্ট্যান্ট সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। কাউন্ট জারোস্লাভ বারিতা অফ মার্টিনিস, কাউন্ট ভিলেম স্লাভাতা অফ ক্লাম, দ্বিতীয় অ্যাডাম ভন স্টার্নবার্গ ও ম্যাথিউ লিওপোল্ড পোপেল লেটজকোভিচ এই চারজন ক্যাথলিক মতানুসারী রাজপ্রতিনিধি হিসেবে প্রাগ দুর্গে পৌঁছন।
আলোচনার শুরুতেই বাতিল হওয়া সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডা চরমে উঠল কাউন্ট থর্ন প্রথম দুই সদস্যকে রেহাই দিলেও পরের দুই রাজপ্রতিনিধিকে তাদেরপ্রোটেস্ট্যান্ট ভাবধারার পক্ষে ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করে ব্যক্তিগত সহায়ক সহ দুর্গের জানলা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আদেশ দেন। এই দুর্গের নিচ থেকে তৃতীয় তলার উচ্চতা ছিল প্রায় ২১ মিটার। উঁচু থেকে নিচে পড়লেও ভন স্টার্নবার্গ ও লিওপোল্ড পোপেল বেঁচে যান কারণ তারা পড়েছিলেন দুর্গের বাইরে রাখা গোবরের গাদার ওপর!
এই ঘটনার পরই বোহেমিয়া ও অষ্ট্রিয়ার নেতৃত্বে হোলি রোমান এম্পায়ারের অন্তর্গত প্রোটেস্ট্যান্ট ভাবধারায় আস্থাশীল রাজ্যগুলি ক্যাথলিক মতানুসারী রাজ্যগুলির সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল।