৩ জুন, ২০২৩শনিবার

৩ জুন, ২০২৩শনিবার

‘সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার সঙ্গে নোনাজলের কোনও সম্পর্কই নেই’

ভারতবর্ষের ব্যাঘ্র-গবেষণার জগতে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব তিনি। এদেশে বাঘ গণনার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতি এবং বাঘের আচরণবিধি বোঝার সুবিধার্থে রেডিও কলার ব্যবহার শুরু হয় তাঁরই হাত ধরে। তিনি কে.উল্লাস কারন্থ। অথচ, প্রথাগতভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ছিলেন। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন প্রযুক্তি জগতে। কিন্তু অরণ্য, বন্যপ্রাণের প্রতি আশৈশব টান তাঁকে ফিরিয়ে আনে বন্যপ্রাণ গবেষণায়। নিজ প্রতিভাবলে হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি-সম্পন্ন ব্যাঘ্র-গবেষক। ২০০৭ সালে কনজারভেশন লিডারশিপের জন্য পেয়েছেন জে.পল গেটি পুরস্কার। ওই একই বছরে স্যাংচুয়ারি এশিয়ার তরফ থেকে পেয়েছেন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। ২০১২ সালে ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেছে পদ্মশ্রী। উল্লাসের বাবা ছিলেন কিংবদন্তী কন্নড় ঔপন্যাসিক কোটা শিবরাম কারন্থ। সাহিত্যিক ছাড়াও বহুমুখী প্রতিভার মানুষ ছিলেন তিনি। বিখ্যাত বাবার পুত্র হয়ে তাঁর ছায়ায় ঢাকা পড়তে দেননি নিজেকে। কথাবার্তায় অকপট, সরকারি অব্যবস্থার বিরুদ্ধে নির্ভীক উচ্চারী উল্লাস এই সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন তাঁর গবেষণা-জীবন নিয়ে। আজকের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে ভারতের বন্যপ্রাণ আইন ও পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মতামত, সরকারি অব্যবস্থা, সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার প্রবৃত্তি, এমন নানাবিধ গবেষণার দিক। শুনেছেন ‘ভিন্নসময়’-এর প্রতিনিধি সোহম দাস

(প্রথামাংশের পর…)

  • হেইলি জাতীয় উদ্যানের কথা আপনি বললেন। এটি সম্ভবত ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়, ওই অঞ্চলের পশুপাখিদের শিকারের হাত থেকে রক্ষার জন্য।

হ্যাঁ, ওটার নামই পরে করবেট জাতীয় উদ্যান হয়েছে। ওটাই ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যান।

 

  • সেক্ষেত্রে এই জাতীয় উদ্যান তৈরিকে কি ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রথম স্তম্ভ হিসেবে ধরা যেতে পারে?

না। সত্যিকারের সংরক্ষণ যদি হয়ে থাকে, সেটা ইন্দিরা গান্ধীর সময়েই হয়েছে। তাঁর আমলেই প্রথম কড়া আইন মোতাবেক বন্যপ্রাণ শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। তার আগে আমরা শুধু বাঘ শিকারেরই গল্প শুনতাম। কিন্তু সেই সময়ে ওভাবে আইন না এনে যদি বন্ধ করা না হত, ভারত থেকে বাঘই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ইন্দিরা গান্ধী ছাড়াও ওই সময়ের যাঁরা ফরেস্ট অফিসার ছিলেন, সঙ্গে সেলিম আলি, জাফর ফতেহালি, বিল্লি অর্জন সিংয়ের মতো কনজারভেশানিস্ট, এছাড়া আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব যেমন পিটার জ্যাকসন, রিক অ্যালবার্ট, এঁরা যদি এগিয়ে না আসতেন, তাহলে কম্বোডিয়া বা ইরানের মতো এদেশেও বাঘ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেত।

 

ছয়ের দশকে আমি যখন নিয়মিত জঙ্গলে যাওয়া শুরু করেছি, ততদিনে বাঘের সংখ্যা একেবারে তলানিতে। অতএব, ১৯৩৬ সাল থেকে সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল, একথা কিছুতেই বলা যাবে না। বাঘের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে ১৯৭১ সালের পর থেকে।

আরও পড়ুন
কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?

'সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার সঙ্গে নোনাজলের কোনও সম্পর্কই নেই'
উল্লাস ও তাঁর ক্যামেরা ট্র্যাপ। ছবি কল্যাণ ভার্মার তোলা। ছবিসূত্র – আর্টিস্টস ফর ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড নেচার

 

  • ভারত স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তারপর থেকে বাঘ বা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ-সম্পর্কিত কোনও আইন আনতে এতগুলো বছর লেগে গেল কেন?

আমি ইন্দিরা গান্ধীর আগের সরকারকে দোষ দিই না। সেই সময়ে যদি ফেরত যাওয়া যায়, দেখা যাবে, তখন ভারতবর্ষ ধুঁকছে। খাদ্যাভাব ছিল, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল মাত্র ২%। সেখানে বাঘের জন্য ভাবার মতো সময় কোথায়? অর্থনীতি স্থিতিশীল হলে তবেই এই দিকগুলোয় নজর দেওয়া যায়। ওই একই সময়ে চীন তাদের দেশ থেকে ব্যাঘ্রকুলকেই পুরো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আমি বরং দায়ী করব ১৯৭১-এর পর থেকে বন্যপ্রাণ সম্পর্কে যে ধরনের ঔদাসিন্য দেখানো হয়েছে, সেই প্রবণতাকে। স্বাধীনতার পর পর নাহয় দারিদ্র্য ছিল, খাদ্যাভাব ছিল। কিন্তু, এখন এই ধরনের কোনও অজুহাত দেওয়া চলবেই না।

 

  • এতবছর ধরে বাঘের সংখ্যা যে কমে এল, তার পিছনে কারণ কি শুধুমাত্র শিকারই ছিল নাকি অন্য কোনও কারণও ছিল?

স্টিল বা গানপাউডার তো অনেক যুগ আগেই এসেছে। তখন তো বাঘের বিলুপ্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যায়নি। পরবর্তীকালে আগ্নেয়াস্ত্র এবং কীটনাশক আসার পর বাঘেরা চরম বিপদের মুখে পড়ে। ভারতের মানুষ কৃষিকাজ বেশি পছন্দ করত। সেই কারণে জঙ্গল কেটে কৃষিকাজ শুরু হয়। এর ফলে, বাঘের মুখে পড়ে শয়ে শয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। তখন অবশেষে নির্বিচারে বাঘ মারা শুরু হয়। তার ফলে, বাঘের সংখ্যা অনেকদিন ধরেই কমেছে।

 

১৮৭৫ থেকে ১৯২৫, এই পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ৭৫০০০ বাঘ মারা পড়ে। মূলত, দুটি কারণ ছিল। এক, স্পোর্ট হান্টিং। দুই, বাউন্টি হান্টিং। বাউন্টি হান্টিংয়ে একটা বাঘ মারলে সেই সময়ে একশো টাকা পাওয়া যেত। সেটা গরীব মানুষের কাছে অনেক। গরীব মানুষ পেটের দায়ে অনেক বেশি বাঘ মেরেছে। অবশ্য, বাঘ মারায় বড়লোকদেরও ভূমিকা কিছু কম ছিল না।

আরও পড়ুন
প্রকৃতিকে বাঁচাতে নারীরাই অগ্রভাগে থাকে কারণ তারা একটা জীবনকে বাঁচাতে চায় – মাইদা বিলাল

'সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার সঙ্গে নোনাজলের কোনও সম্পর্কই নেই'
রেডিও টেলিমেট্রি। ছবি – অ্যালকেট্রন

কিন্তু, বাঘেদের উপর সবথেকে ক্ষতিকর প্রভাব এসে পড়েছে যখন তার যে স্বাভাবিক শিকার, সেই প্রাণিগুলোকে মানুষ মারতে শুরু করেছে। এখনও ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিপুল বনভূমি রয়েছে, কিন্তু সেখানে কোনও বাঘ নেই। কারণ, স্থানীয় লোকজন বাঘের শিকার করার প্রাণিগুলোকে শেষ করে দিয়েছে। এমন একাধিক কারণে বাঘের সংখ্যা আজ এত কমে গেছে।

 

  • আপনি ১৯৭১-এর আগের সময়টাও দেখেছেন, পরবর্তী সময়টাও দেখেছেন। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন আসার ফলে যেসব জায়গা একসময় জনপ্রিয় শিকারক্ষেত্র ছিল, সেগুলো সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পরিণত হল। আপনার চোখে এই পরিবর্তনটা কীভাবে ধরা পড়েছে?

কিছু কিছু শিকারের জায়গা সংরক্ষিত অরণ্যে পরিণত হয়েছে, তবে সব নয়। যেমন, নগরহোল বা কাজিরাঙা কখনোই শিকারক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত ছিল না। কানহা, রণথম্ভোরে হয়তো ভালো পরিমাণেই শিকার হত। তবে তুমি যদি জানতে চাও যে, সংরক্ষণ আইন আসার ফলে বাঘেদের উপকার হয়েছে কিনা, আমি বলব, তা তো হয়েছেই। ছয়ের দশকের শেষদিকে বহু জায়গা থেকে বাঘ প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। তেমন বহু জায়গায় আবার তারা ফিরে আসে। সেটা শিকারক্ষেত্র হোক বা না হোক।

 

মূল কারণ ছিল, কড়া আইন করে বাঘশিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কড়া আইন না আনলে এদেশে কিছুই হয় না। কেউ যদি ভেবে থাকে, আইনের প্রয়োজন নেই, মানুষই বাঘকে রক্ষা করবে, সেটা ভুল ভাবনা। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ডে কী হয়েছে, তা তো দেখাই যাচ্ছে। নাগাল্যান্ড থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাঁচের দশক অবধিও ওখানে বাঘের দেখা পাওয়া যেত।

 

  • সরকারি মতে, ২০১০ সাল থেকে বাঘের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু একইসঙ্গে জনসংখ্যাও বাড়ছে। সেখানে বাঘ আর মানুষের মধ্যে সংঘাত তো অবশ্যম্ভাবী। সেক্ষেত্রে বাঘ সংরক্ষণের ভবিষ্যৎ কী?

বাঘের সংখ্যা বাড়ছে, এটা সরকারি হিসাব। আমি সেগুলোকে সঠিক তথ্য বলে মনেই করি না। সরকার একবার বলছে, বাঘের সংখ্যা কমছে, আবার বলছে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। ১৯৭০ সালে যখন ব্যাঘ্র প্রকল্প এবং অন্যান্য সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু হয়, তখন ভারতে বাঘের সংখ্যা ছিল ২০০০। তারপরে ধীরে ধীরে আটের দশকের শেষের দিকে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩০০০-এ। এখনও সংখ্যাটা ওই ৩০০০-এর আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। তোমরা খবরের কাগজে যে সংখ্যাগুলো দেখো, সেগুলো পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক।

 

যেমন, ২০০৬ সালে হঠাৎ বলা হল, বাঘের সংখ্যা নাকি ১৪০০-তে নেমে গেছে। তারপর আবার বলা হচ্ছে, বাঘের সংখ্যা নাকি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এটা আসলে একটা পরিষ্কার নাম্বার গেম, যেটার পিছনে রয়েছে অশিক্ষিত আমলাতন্ত্র এবং মধ্যমেধার বিজ্ঞানীমহল। অতএব, বাঘের সংখ্যা বাড়ার সরকারি হিসাবকে আমি কোনও আমলই দেব না।

 

তোমার মূল যে প্রশ্নটা, এত বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে বাঘের ভবিষ্যৎ কী, সেটার উত্তর আমি দিতে পারি। তবে আবারও বলে রাখি, সরকারি হিসাব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজনই নেই এক্ষেত্রে। এবার উত্তরে আসি। আজকের ভারতের দিকে যদি তাকানো যায়, সেখানে তিন লক্ষ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে ঘন বনভূমি রয়েছে, যেখানে বাঘেরা স্বচ্ছন্দেই বিচরণ করতে পারে। আমি এখানে বলছি, সংরক্ষিত বনভূমির কথা, যেগুলো সরকার-সুরক্ষিত। বেসরকারি জমির কথা আমি বলছি না। সেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে যদি পাঁচটা করে বাঘও থাকে, সেক্ষেত্রে প্রায় ১৫০০০ বাঘ ভারতবর্ষে বাস করতে পারবে। বাঘেদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত যে জঙ্গলগুলো, যেমন নগরহোল, কাজিরাঙা, বা কানহা, সেখানে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১৫টা বাঘ থাকে।

আরও পড়ুন
ছ’মাস বয়সী শিশুকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে, আমরা তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে কবর দিয়েছি

'সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার সঙ্গে নোনাজলের কোনও সম্পর্কই নেই'
বিল্লি অর্জন সিং। ছবি – স্যাংচুয়ারি নেচার ফাউন্ডেশন

অর্থাৎ, আমরা এখনও ওই ৭০০০ বা ১০০০০ সংখ্যাটার কাছাকাছিও কোথাও নেই। সেটার জন্য দরকার নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে এগোনো। আমাদের লক্ষ্য স্থির নেই, আমাদের নির্দিষ্ট দর্শন নেই। আমরা কেবল টাকা ঢেলে চলেছি, আর বলছি, আমরা সফল।

 

তাহলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি সেক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে? হ্যাঁ, হতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে মানুষজন জঙ্গল এলাকা থেকে অনেক বেশি শহর বা শহরতলির দিকে চলে আসবে। সেক্ষেত্রে জঙ্গল এলাকায় শিকার বা গবাদি পশু চারণের চাপ অনেক কমে যাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি সঠিক পথে হয়, সেক্ষেত্রে এই কাজ অনেক সহজেই হবে। উত্তরাখণ্ড বা কর্ণাটকের পাহাড়ি অঞ্চলে এটা সম্ভব হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ এক সময়ে বন্যপ্রাণের উপর খাবারের জন্য ভীষণভাবে নির্ভরশীল ছিল, এখন সেই চিত্র বদলাচ্ছে। কারণ, মানুষ যদি বন্যপ্রাণকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে, বন্যপ্রাণির বেঁচে থাকার কোনও আশা থাকবে না।

 

অতএব, আমি উন্নয়নকে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করি না। আসল বিষয়টা হচ্ছে, উন্নয়নটা কোথায় হচ্ছে এবং সেটা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী হচ্ছে।

 

  • বাঘ আর মানুষের মধ্যে সংঘাতের যে জায়গাটা বারবার তুলে ধরা হচ্ছে, সেটার ফল হিসেবে বাঘেদের খাদ্যাভ্যাসে কি কোনও পরিবর্তন আসছে? বন্য তৃণভোজী প্রাণি থেকে গবাদি পশুর দিকে কোনোরকম পরিবর্তন কি দেখা যাচ্ছে?

আমার তা মনে হয় না। কিছু জায়গায় হয়তো হতে পারে। কিন্তু এমনিতে এমন ব্যাপার ঘটবে না। কারণ, বাঘেরা এখন অনেক বেশি সংরক্ষিত অরণ্যে থাকে। ফলে তারা বন্য তৃণভোজী প্রাণিই বেশি শিকার করে। একশো বছর আগে, যখন বাঘ-মানুষের সংঘাত অনেক বেশি ছিল, তখন তারা অনেক বেশি গবাদি পশু শিকার করত।

 

  • কৌতূহল থেকে একটি প্রশ্ন করছি। সুন্দরবনের বাঘেরা সাধারণত নরখাদক হয় কেন?

বাঘেরা পারতপক্ষে তারা মানুষকে মারে না। অন্যতম কারণ, মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে গণহারে শিকার করে এসেছে। ফলে বাঘেরা সাধারণত মানুষকে ভয় পায় এবং এড়িয়ে চলে। কিন্তু সুন্দরবন এমন একটি অঞ্চল যেখানে স্থানীয় মানুষের পক্ষে বাঘ শিকার করা সম্ভব নয়। ফাঁদ পেতে বা হাতির পিঠে চেপে বা অন্য যেকোনো উপায়ে সুন্দরবনে বাঘ শিকার অসম্ভব। সেজন্য, সুন্দরবনের বাঘ মানুষকে সেভাবে ভয় পায় না।

আরও পড়ুন
শঙ্কর চক্রবর্তীকে বলেছিলাম তুমি যদি কালী ব্যানার্জির অভিনয় দেখে থাকো সেটা ভুলে যাও

'সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার সঙ্গে নোনাজলের কোনও সম্পর্কই নেই'
সুন্দরবনের বাঘ মানুষকে ভয় পায় না। ছবি – স্ক্রল.ইন

দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনে বাঘের স্বাভাবিক খাদ্যও বেশ কম। এখানকার বাঘের আকারও ছোট। তেরাই বা পশ্চিমঘাট পর্বতের নানা অংশে যে আকারের বাঘ দেখতে পাওয়া যায়, তার তুলনায় বেশ ছোট। সেখানে হরিণ বা শূকরজাতীয় প্রাণির সংখ্যা কম হওয়ার ফলে, কোনও অসহায় মানুষকে কাছাকাছি দেখলেই তারা আক্রমণ করে। মানুষ শিকারের পর তাদের নিজেদের আক্রান্ত হওয়ার সুযোগও যেহেতু খুব কম, মানুষকে তারা ভয় পায় না। সব বাঘ না হলেও বেশিরভাগ বাঘের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।

 

আমি এটা পুরোপুরি অনুমানের উপর ভিত্তি করেই বলছি। এর পিছনে কোনও প্রামাণ্য ডেটা নেই। আমার এতবছরের অভিজ্ঞতায় বাঘের আচরণবিধি সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, তার উপরে ভিত্তি করেই এটা বললাম।

 

  • তাহলে নোনাজলের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই?

একেবারেই নয়। এই আচরণের পিছনে নোনাজলের কোনও ভূমিকাই নেই। এশিয়ার অন্যান্য দেশে, যেমন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াতেও বাঘেরা প্রায় একই পরিবেশে থাকে। সেখানেও জল লবণাক্ত। কিছু বিদেশি বিজ্ঞানী এসে বলে গেছেন, নোনাজলের জন্য এখানকার বাঘেরা মানুষখেকো, আর আমরা সেটাকেই সত্যি বলে ধরে নিয়েছি। আমার সেটা একেবারেই মনে হয় না। মূল কারণ হল, স্বাভাবিক শিকারের অভাব এবং মানুষের প্রতি ভয় না থাকা।

 

  • ব্যাঘ্রপ্রকল্পের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। এবছর আরও দুটো নতুন ব্যাঘ্রপ্রকল্পের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তামিলনাড়ুর মেঘমালাই এবং উত্তরাখণ্ডের রামগড়। এই প্রসঙ্গে আমি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলতে চাই। আমি ২০১৯ সালে জয়ন্তী গিয়ে একজন স্থানীয় মানুষের মুখে শুনেছিলাম যে, বক্সা-জয়ন্তী ব্যাঘ্রপ্রকল্পে টানা কয়েক দশক কোনও নিবাসী বাঘ (resident tiger) দেখা যায়নি। তারপরেও ব্যাঘ্রপ্রকল্পের নামে প্রচুর টাকা আসছে। কিন্তু সে টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে, কেউ জানে না। আশেপাশের গ্রামের উন্নতিতেও তা কোনও কাজে লাগছে না। এর নেপথ্য কাহিনীটি আপনি বলতে পারেন?

বক্সার কথা আমি নির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না। কিন্তু এটা বলতে পারি, ভারতবর্ষে প্রতিবছর যে ব্যাঘ্রপ্রকল্পের ঘোষণা হচ্ছে, এর পিছনে সঠিক কোনও বিজ্ঞান বা যুক্তি, কিচ্ছু নেই। ৯টা থেকে এখন ৫০-এর উপরে চলে গেছে সংখ্যাটা (৫২)। যখন-তখন এমন ব্যাঘ্রপ্রকল্পের নাম ঘোষণা হচ্ছে সরকারি মহলের ইচ্ছায়, রাজনীতিবিদদের ইচ্ছায়। সেখানে আমলাদের ইচ্ছা নয় বলে অনেক সঠিক জায়গা বাদ পড়ে যাচ্ছে। ফলে, এই জায়গাগুলো কেন ব্যাঘ্রপ্রকল্প আর অন্যান্য উপযুক্ত জায়গাগুলো কেন নয়, সেটা একটা বড়ো সমস্যা।

 

এই সমস্যার আরও একটা নেতিবাচক দিক আছে। এনটিসিএ (NTCA, National Tiger Conservation Authority) এবং তাদের অকর্মণ্য আমলারা হাজারো নিয়ম বসাচ্ছে, যেগুলো রাজ্য সরকারগুলোকে কোনোরকম সাহায্য করছে না। এটা কেবল একটা লেবেলে পরিণত হয়েছে। আগে যখন ব্যাঘ্রপ্রকল্প ঘোষণা হত, তার একটা পরিষ্কার অর্থ ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার নীতি নিয়ে ভাবত, উপযুক্ত বিজ্ঞানীদের নিযুক্ত করত। সেসব দিন এখন অতীত, এখন সবটাই অর্থহীন। এখন টাইগার রিজার্ভ একটা বাজেট লাইন। টাইগার রিজার্ভ ঘোষণা করলেই প্রচুর টাকা আসবে প্রকল্পে, সেই কারণে বহু সরকার তা মেনেও নেয়। কিন্তু কর্ণাটকের মতো রাজ্যে বলাই হয়েছে, আমরা আর ব্যাঘ্রপ্রকল্প চাইছি না।

 

এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ নতুন একটি টাইগার টাস্কফোর্সের প্রয়োজন। যখন-তখন ব্যাঘ্রপ্রকল্পের ঘোষণার এই প্রবণতা, এনটিসিএ, এই অযোগ্য আমলাতন্ত্র, সবকিছুতেই বড়োসড়ো বদল চাই।

 

  • সম্প্রতি একটি খবর আমরা দেখলাম। অতিমারীর কারণে পর্যটনে যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতি পূরণ করতে করবেট এবং রাজাজি জাতীয় উদ্যান সারাবছর খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাঘেদের সঙ্গমের সময়েও এভাবে পর্যটনের জন্য উদ্যান খুলে রাখা কি যুক্তিযুক্ত?

এই খোলা-বন্ধ করার ব্যাপারটা আমার ঠিক বোধগম্য হয় না। দক্ষিণ ভারতের অনেক উদ্যানই তো সারাবছর খোলা থাকে। সেখানে তো তেমন কোনও অসুবিধা হয় না।

আরও পড়ুন
বাবা বললেন My dear son reflected glory will spoil you তুমি নিজে থেকে কিছু করো

'সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার সঙ্গে নোনাজলের কোনও সম্পর্কই নেই'
সেলিম আলি। ছবি – উইকিমিডিয়া কমন্স

  • রণথম্ভোর ভারতের অন্যতম জাতীয় উদ্যান, যেখানে গেলেই বাঘ দেখতে পাওয়া যায়। সেখানকার বাঘেরাও দীর্ঘদিন ধরে ট্যুরিস্ট গাড়ি, মানুষ দেখে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তারপরেও মাঝে মাঝে দেখা যায়, বাঘ ট্যুরিস্ট গাড়িকে তাড়া করেছে। অতিরিক্ত ব্যাঘ্র-পর্যটন কি বাঘেদের উপর কোনও কারণে চাপ সৃষ্টি করছে?

অতিরিক্ত ব্যাঘ্র-পর্যটন কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমার মনে হয়, কয়েকটা মাত্র নির্দিষ্ট জঙ্গলের উপর চাপ সৃষ্টি না করে ব্যাঘ্র-পর্যটনের পরিসর বাড়ানো উচিত। অন্যান্য জঙ্গলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ব্যাঘ্র-পর্যটন শুরু করলে কোনও একটা জঙ্গলের উপর এভাবে চাপ পড়বে না। ব্যাপারটাকে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।

 

  • বন্যপ্রাণিদের নিয়ে যিনি ছবি বানান, সেই চিত্রনির্মাতা কৃষ্ণেন্দু বোসকে দেওয়া আপনার একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বিজ্ঞান মহলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে কথা বলেছিলেন। পান্না প্রকল্পের বাঘ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রঘু চুন্দাওয়াতের মতো নির্ভীক বৈজ্ঞানিককে যে ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, বা জঙ্গলে প্রবেশের জন্য আপনার বিরুদ্ধেও যেসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, সেইসব বিষয়ে আপনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বিজ্ঞান মহলে এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ঘটনা ঘটার পিছনে কারণ কী?

আমরা বাঘ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা বলি। কিন্তু, বর্তমানে বিজ্ঞানের অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে, শুধুমাত্র সরকারি আধিকারিক এবং সরকারি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারবে। অন্য লোকজনকে জঙ্গলে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি লোকজনের হেল্পার, সহকারী হয়ে ঢুকতে চাইলে তবেই সেই অনুমতি পাওয়া যাবে। আর সরকারের সমালোচনা করলে তো পুরোপুরি তাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। এই প্রবণতা বিজ্ঞানের পরিপন্থী। এই কারণে ভারতে বন্যপ্রাণ গবেষণা এগোতে পারছে না।

 

তরুণ, উৎসাহী গবেষকরা সুযোগ পাচ্ছে না। তারা গবেষণাগারে বসে শুধুমাত্র জেনেটিক্স নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি মহলে নিযুক্ত রয়েছে মধ্যমানের বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় তাদেরই একচেটিয়া আধিপত্য। অন্য কাউকে জায়গা দেওয়া হচ্ছে না। আর এই অবস্থাটা দিনকে দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। আমার গবেষণার কাজ শেষ হয়েছে, আমার বয়সও হয়েছে। কিন্তু আমি এখন তরুণ গবেষকদের কথা ভেবে খুবই চিন্তিত। বন্যপ্রাণ গবেষণায় এই সরকারি মোনোপলি যথেষ্ট ক্ষতি করছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকার বেসরকারি স্টার্ট-আপকে জায়গা দিচ্ছে, কিন্তু এই সেক্টরের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সরকারি মোনোপলি চলছে, স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো।

 

  • ওই সাক্ষাৎকারে আপনি পি. কে. সেনের (প্রোজেক্ট টাইগারের প্রাক্তন ডিরেক্টর) কথা বলেছিলেন। উনি তো বোধহয় এবছর চলে গেলেন?

হ্যাঁ, পি. কে. সেন এই বছর কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। আমার গোটা কেরিয়ারে দেখা অন্যতম সেরা ফরেস্ট অফিসার ছিলেন পি. কে. সেন। তাঁর নিজস্ব দর্শন ছিল, উনি যোগ্য মানুষকে সুযোগ দিতেন, বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা করতেন। কাজ করিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল ঈর্ষণীয়। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি তাঁর সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তারপর তো তাঁকে অবসর নিতেই হয় মেয়াদ ফুরোলে। পি. কে. সেন সম্ভবত ১৯৯৭ সালে অবসর নেন, কিন্তু গুটিকতক মানুষের মধ্যে একজন, যাঁরা অবসরের পরেও যথেষ্ট প্রভাব রেখেছেন। তাঁকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি।

আরও পড়ুন
আমাদের এখানে আলোকসজ্জার বিবর্তনের কথা যদি বলতে হয় সেটা একপ্রকার ছেলেখেলা-দীপক মুখোপাধ্যায়

'সুন্দরবনের বাঘেদের নরখাদক হওয়ার সঙ্গে নোনাজলের কোনও সম্পর্কই নেই'
জাফর ফতেহালি। ছবি – অরবিন্দ গুপ্তা তোয়া

  • শহরের মানুষ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করতে পারে?

ভারতবর্ষে নগরায়ণ এখন আরও দ্রুত হারে হচ্ছে। ফলে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে শহরের মানুষের প্রভাব আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। মিডিয়া এখন এত বেড়েছে। তারা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু আগে তাদের নিজেদের ভূমিকাটা বুঝতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, তারা সারাদিন ফেসবুক আর ভুয়ো তথ্যের মধ্যে ডুবে আছে। সরকারকে নীতি বদল করতে বাধ্য করার জন্য তারা নিজেদের প্রকৃত শক্তিকে ব্যবহারই করছে না। বেশিরভাগ সময়ে রাস্তার ক’টা কুকুরকে খাইয়েই তাদের পশুপ্রেম শেষ। তারা অনেক কিছুই করতে পারে, কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবিত নয়। ‘আর্বান ইন্ডিয়া’-র হাতে এখন অনেকটাই ক্ষমতা। কিন্তু সেই ক্ষমতাকে তারা খুব বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে ব্যবহার করছে না।

 

  • শেষ প্রশ্ন। দ্রুত হারে এই যে নগরায়ণ হচ্ছে, সঙ্গে শিল্পায়ন, এই কারণে যথেচ্ছ বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, তা তো বাঘেদের বিচরণভূমির উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করছে। সেক্ষেত্রে, এই সংরক্ষণ কাজের ভবিষ্যৎ কী?

নগরায়ণ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁধ নির্মাণ, বা শিল্পের জন্য বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, তা তো ঠিকই। তা খুব ভালো সংকেত একেবারেই নয়। কিন্তু আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি যে কারণে জঙ্গল ধ্বংস হয়েছে, তা হল কৃষি। সেক্ষেত্রে জঙ্গল কেটে যেসব জায়গায় কৃষিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোকে আবার পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রান্তীয় কৃষিক্ষেত্রগুলোকে (marginal farm lands) আবার জঙ্গলের অংশ হিসেবে ফিরিয়ে দিতে হবে।

 

কিন্তু সেটা করতে গেলে আরও উন্নত করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ছোট জায়গায় যাতে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় শস্য উৎপাদন করা যায়, সেটা দেখতে হবে। যতটা সম্ভব কম জল ব্যবহার করে, কম কীটনাশক ব্যবহার করে কৃষিকাজ করতে হবে।

 

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: তিষ্য দাশগুপ্ত ও সেন্টার ফর ওয়াইল্ডলাইফ স্টাডিজ

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!