৩ জুন, ২০২৩শনিবার

৩ জুন, ২০২৩শনিবার

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?

ভারতবর্ষের ব্যাঘ্র-গবেষণার জগতে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব তিনি। এদেশে বাঘ গণনার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতি এবং বাঘের আচরণবিধি বোঝার সুবিধার্থে রেডিও কলার ব্যবহার শুরু হয় তাঁরই হাত ধরে। তিনি কে.উল্লাস কারন্থ। অথচ, প্রথাগতভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ছিলেন। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন প্রযুক্তি জগতে। কিন্তু অরণ্য, বন্যপ্রাণের প্রতি আশৈশব টান তাঁকে ফিরিয়ে আনে বন্যপ্রাণ গবেষণায়। নিজ প্রতিভাবলে হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি-সম্পন্ন ব্যাঘ্র-গবেষক। ২০০৭ সালে কনজারভেশন লিডারশিপের জন্য পেয়েছেন জে.পল গেটি পুরস্কার। ওই একই বছরে স্যাংচুয়ারি এশিয়ার তরফ থেকে পেয়েছেন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। ২০১২ সালে ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেছে পদ্মশ্রী। উল্লাসের বাবা ছিলেন কিংবদন্তী কন্নড় ঔপন্যাসিক কোটা শিবরাম কারন্থ। সাহিত্যিক ছাড়াও বহুমুখী প্রতিভার মানুষ ছিলেন তিনি। বিখ্যাত বাবার পুত্র হয়ে তাঁর ছায়ায় ঢাকা পড়তে দেননি নিজেকে। কথাবার্তায় অকপট, সরকারি অব্যবস্থার বিরুদ্ধে নির্ভীক উচ্চারী উল্লাস এই সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন তাঁর গবেষণা-জীবন নিয়ে। আজকের প্রথম পর্বে থাকছে তাঁর এই যাত্রাপথের শুরুর দিনগুলো, বাবা-মা’র কথা, ক্যামেরা ট্র্যাপ ও রেডিও টেলিমেট্রির কার্যকারিতা, ফ্রেডেরিক চ্যাম্পিয়ন, জিম করবেট ও কেনেথ অ্যান্ডারসনের মতো ব্যক্তিত্বদের কথা। শুনেছেন ‘ভিন্নসময়’-এর প্রতিনিধি সোহম দাস

 

  • প্রথাগতভাবে আপনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কাজ করলেন ব্যাঘ্র গবেষণা এবং ব্যাঘ্র সংরক্ষণ নিয়ে। এই কাজের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?

আমার বাবা ছিলেন সাহিত্যিক এবং বহুমুখী প্রতিভাধর একজন মানুষ। তাঁর জন্ম ১৯০২ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তিনিও স্কুল ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সেই কারণে আমিও সিক্সথ গ্রেড অবধি স্কুলে যাইনি। বাবা নিজে প্রকৃতি ভালোবাসতেন, আর আমার এক মাসি, যিনি আমার মায়ের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন, তিনি আমায় পাখি চিনতে শিখিয়েছিলেন। ফলে আমিও ছোট থেকে প্রকৃতি খুব ভালোবাসি।

 

আমার জন্ম ১৯৪৮ সালে। ’৬৫ সালে আমার বয়স যখন ১৭, তখন কোন বিষয়ে নিজের কেরিয়ার গড়ব, সেটা বেছে নেওয়ার সময় এসে পড়ল। আর সেই সময়ে, দক্ষিণ ভারতে ভালো বেতনের চাকরির জন্য হয় বায়োলজি অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রিম বেছে নিতে হত। বায়োলজি নিতে আমি আগ্রহী ছিলাম না, কারণ বায়োলজি পড়ে তখন শুধু ডাক্তার হওয়া যেত। বন্য জীবজন্তুদের নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল না। আর, ডাক্তারিতেও আমার কোনও আগ্রহ ছিল না। সেই কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নিলাম। সেক্ষেত্রে, আমি ভালো বেতনের চাকরিও যেমন পাব, সঙ্গে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরা, পাখি দেখা, এই শখপূরণগুলোও হবে।

আরও পড়ুন
প্রকৃতিকে বাঁচাতে নারীরাই অগ্রভাগে থাকে কারণ তারা একটা জীবনকে বাঁচাতে চায় – মাইদা বিলাল

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
কাজের ফাঁকে কে উল্লাস কারন্থ

সুরথকলের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু ক্লাসে ঢোকার পরেই বুঝলাম, এই বিষয়েও আমার তেমন কোনও আগ্রহ নেই। বেশিরভাগ ক্লাসই করতাম না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঢুকেছিলাম ভালো ছাত্র হিসেবে, কিন্তু পরে সেই বিষয় থেকেই আমার আগ্রহ চলে যায়। ওই সময়টাতে আমি বিভিন্ন জঙ্গলে ঘুরতাম, নানা পশুপাখিকে খুঁটিয়ে দেখতাম, তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতাম। ইঞ্জিনিয়ারিংটা অবশ্য পাশ করি, তারপর প্রায় ১০-১৫ বছর চাকরি করেছি।

কিন্তু মনের মধ্যে ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজিস্ট হওয়ার ইচ্ছেটা রয়েই গিয়েছিল। মন থেকে আমি সবসময়েই চেয়েছি ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজিস্ট হতে। অবশেষে সেই বাঁকবদলটা সম্ভব হয়েছিল।

 

  • অর্থাৎ, ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজির ক্ষেত্রে আপনার কেরিয়ার শুরু হয়েছিল কিঞ্চিৎ দেরিতে?

কেরিয়ার শুরুর কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব, এর দুটো দিক আছে। সংরক্ষণের কাজ কিন্তু আমি নিজের ইচ্ছায় অনেক আগে থেকেই করেছি। আমার বয়স যখন ২৫-২৬-এর আশেপাশে, তখন থেকেই বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য লড়াই করছি। প্রথাগতভাবে গবেষক হতে পেরেছি ৪০-এর কাছাকাছি বয়সে।

 

  • আপনার বাবার কোটা শিবরাম কারন্থের লেখা আমার এখনও পড়া হয়নি। কিন্তু আর. এস. মুগালি-র ‘কন্নড সাহিত্যের ইতিহাস’ পড়ে জেনেছি যে, তিনি লেখার জন্য প্রচুর ঘুরতেন। তাঁর লেখায় উঠে আসত আঞ্চলিক উপাদান, প্রকৃতির বর্ণনা, গ্রামীণ মানুষের সুখদুঃখ, সামাজিক পরিকাঠামো। এছাড়াও তিনি নিজেও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেছেন। এখানেই আমার প্রশ্ন, আপনার জীবনে তাঁর বা তাঁর কাজের প্রভাব কতখানি?

 

তাঁর একটা বড়ো প্রভাব বরাবরই আমার জীবনে রয়ে গেছে। তিনি মূলত ঔপন্যাসিক ছিলেন, কিন্তু সেটা তাঁর কাজের একটা দিক মাত্র। যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২০ সালে কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে সেই সংগ্রামে লিপ্ত হন। গান্ধীর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, তিনের দশক অবধি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এই কাজে। তারপর গান্ধীর প্রতি তাঁর মোহ কেটে যায়, কারণ তিনি ছিলেন অনেক বেশি মডার্নিস্ট।

আরও পড়ুন
ছ’মাস বয়সী শিশুকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে, আমরা তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে কবর দিয়েছি

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
কোটা শিবরাম কোরান্থ

তিনের দশকে প্রথম ছোটদের জন্য সায়েন্স এনসাইক্লোপিডিয়া তাঁর লেখা, তারপর আবার পাঁচের দশকে কন্নড় ভাষার প্রথম সায়েন্স এনসাইক্লোপিডিয়াও তাঁরই লেখা। অর্থাৎ, আমার বাবা প্রকৃত অর্থেই একজন বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন। এমন একজন মানুষের প্রভাব তো তাঁর সন্তানের জীবনে সবসময়েই থাকবে। কিন্তু আমি সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছি তাঁর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার। আমি বরাবর নিজের পছন্দের বিষয়, অর্থাৎ, বিজ্ঞান, বন্যপ্রাণ, এসব নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি। সাহিত্যের দিকে যাইনি। বাবা বহুমুখী মানুষ ছিলেন, আমার চিন্তাধারা বরং অনেকটাই একমাত্রিক।

 

  • রামচন্দ্র গুহ বলেছিলেন ‘শিবরাম কারন্থ কন্নড় সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।

হ্যাঁ। এটা শুনে অনেক বাঙালিই হয়তো ক্ষুব্ধ হবেন। বাবা তো রবীন্দ্রনাথের দ্বারা ভীষণই অনুপ্রাণিত ছিলেন। তবে, আমার মনে হয়, তাঁর কাজের পরিসর রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বিস্তৃত। তিনি বৈজ্ঞানিকও ছিলেন, ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।

 

  • আপনার মা-ও (লীলা কারন্থ) নিজ প্রতিভায় ভাস্বর ছিলেন। নৃত্যশিল্পী ছিলেন, দক্ষ অনুবাদক ছিলেন। অর্থাৎ, আপনার বেড়ে ওঠা একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে। এমন একটি পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা আপনার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত বিকাশের ক্ষেত্রে কীভাবে সাহায্য করেছে?

এরকম একটি পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা আশীর্বাদ তো বটেই। অনেক সময়েই গুরুজনেরা তাঁদের সন্তানদের বলেন হয় ইঞ্জিনিয়ার হতে, অথবা আইএএস, ইউপিএসসিতে যোগদান করতে। সন্তানদের জন্য লক্ষ্যটা তাঁরাই স্থির করে দেন, এতে ছেলেমেয়েদের উপর চাপ পড়ে। কিন্তু আমাদের বাবা-মা কখনও এমনটা করেননি। তাঁদের উপদেশ ছিল, তোমার যা ভালো লাগে, তাই করো। এবং, নিজের চেষ্টায় সবকিছু করো, কারোর উপর নির্ভরশীল হয়ে থেকো না। আমরা তিন ভাইবোনই এই শিক্ষা তাঁদের থেকে পেয়েছি।

 

  • এবার আপনার কাজের জগত নিয়ে প্রশ্নে ফিরব। ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজির ফিল্ডে আপনার এই যা যাত্রা, সেটা নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইব।

ব্যাপারটা হচ্ছে, কেউ সামান্য কিছুদিন জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে হাত নেড়ে বলতেই পারে যে, আমি একজন বাঘ-বিশেষজ্ঞ বা আমি একজন সংরক্ষণবিদ হয়ে গেছি। কিন্তু বিষয়টাকে ঠিকভাবে জানা, প্রশিক্ষণ নেওয়া আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল। বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজি খুবই ভালো, কিন্তু এটা তখন ভারতে পড়ানোই হত না। এখনও এই বিষয়টাকে যেভাবে পড়ানো হয়, তা খুবই মধ্যমানের। বহু পরিবেশবিদকেই আমি চিনতাম, জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জানোয়ারের পায়ের ছাপ চিনেছিলাম। ফিল্ডে কাজ করতে যে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সেগুলো কিছু কিছু রপ্ত করেছিলাম। কিন্তু, এটার পিছনে যে বিজ্ঞান, সেই পড়াশোনাটার প্রয়োজন ছিল।

আরও পড়ুন
শঙ্কর চক্রবর্তীকে বলেছিলাম তুমি যদি কালী ব্যানার্জির অভিনয় দেখে থাকো সেটা ভুলে যাও

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
সেন্টার ফর ওয়াইল্ডলাইফ স্টাডিজের নিজ দপ্তরে উল্লাস। ছবি: সন্দেশ কাদুর

এরপর, ১৯৮৩ সালে, বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির শতবর্ষ সভায় আমি গিয়েছিলাম। তার আগে বাঘ নিয়ে কিছু লেখালেখি করেছি, তবে তার মধ্যে সেভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কিছু ছিল না। ওই সভায় মেল সানকুইস্টের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মেল সানকুইস্ট প্রথম নেপালের চিতওয়ানে টাইগার ট্র্যাকিংয়ের কাজে রেডিও ট্র্যাকিং পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বাঘ নিয়ে আমার এই যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। ছয়ের দশকে জর্জ শ্যালার তাঁর কাজ নিয়ে যেসব লেখা লিখেছিলেন, আমি সেগুলো পড়েছিলাম।

 

মেল সানকুইস্ট আমাকে পছন্দ করেছিলেন। এরপর আমি জি. আর. ই. পরীক্ষা দিই, ভালো ফলও করি। কারণ, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কারণে অঙ্কে বেশ পটু ছিলাম। ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডায় পড়ার সুযোগ পাই। তারপর ১৯৮৭ সালে, যখন আমার বয়স ৩৯, তখন অবশেষে ফর্ম্যাল ট্রেনিং শেষ করলাম। ফলে, এখন আমি দিব্যি নিজেকে সুপ্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী বলতে পারি। এবং, আমার ছাত্রছাত্রীরাও প্রত্যেকেই প্রতিভাবান।

 

  • বাঘের উপর লেখা নিয়ে যে সংকলনটি আপনি সম্পাদনা করেছেন, ‘Tiger Tales’, সেটাতে আপনি যেভাবে নির্দিষ্ট শ্রেণি অনুযায়ী বইয়ের অধ্যায়গুলোকে সাজিয়েছেন নির্দিষ্ট শ্রেণি অনুযায়ী, সেটা আমার খুব ভালো লেগেছে। বইয়ের ভূমিকাতে আপনি লিখেছেন, এই বইটিতে মূলত ভারতবর্ষের বাইরের বাঘ নিয়ে লেখা হয়েছে। এটা আমরা জানি যে, তিনটি বিদেশি প্রজাতির বাঘ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত – জাভা, বালি এবং কাস্পিয়ান। আমার প্রশ্ন, বর্তমানে ভারতের বাইরে বাঘেদের অবস্থা কীরকম?

বইটা করার অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছিলাম পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার সম্পাদক ভি. কে. কার্তিকার থেকে। আমি তাঁকে সেভাবে চিনতামই না, কিন্তু উনি জানতেন জঙ্গল এবং বাঘ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে। সেটা জেনেই তিনি আমায় বলেন, এরকম একটা বই আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না, কারণ বেশিরভাগই এদেশের বাঘ নিয়ে বিভোর। পশ্চিমের দিকের মানুষেরা রণথম্ভোর নিয়ে গর্ব করে, বাঙালিরা সুন্দরবন নিয়ে গর্বে মশগুল।

আরও পড়ুন
বাবা বললেন My dear son reflected glory will spoil you তুমি নিজে থেকে কিছু করো

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
প্রথম যুগের ক্যামেরা ট্র্যাপে ফ্রেড চ্যাম্পিয়নের তোলা একটি বাঘের ছবি। সূত্র – বিবিসি নিউজ

একসময়ে এশিয়ার যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বাঘের বিচরণ ছিল, তা মোটামুটি এখনকার প্রায় ৩০টা দেশকে নিয়ে। ইরান থেকে রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক, আর ওদিকে আর্মেনিয়া থেকে বালি অবধি বাঘ দেখা যেত। ইতিহাসের পাতায় সেইসব বাঘেদের কথা জানা যায়। বইটার উদ্দেশ্য ছিল, সেইসব ইতিহাসকে আবার ফিরিয়ে আনা। এই চ্যালেঞ্জটা আমার খুব মনে ধরেছিল। ‘ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি’-র হয়ে আমি বহু জায়গায় ঘুরি। যেখানে যেখানে বাঘ পাওয়া যায়, সেসব জায়গায় আমি ঘুরেছি।

 

ভারতের বাইরে পরিস্থিতি অনেক আলাদা। প্রজাতি অনুযায়ী বায়োলজিক্যাল পরিবর্তন ঘটেছে, সংস্কৃতিও সেখানে ভিন্ন। ‘Tiger Tales’ সেই বৈচিত্র্যটাকেই ধরতে চেয়েছে। লেখাগুলো পড়ে সেগুলোকে এক জায়গায় আনার কাজটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। সত্যি কথা বলতে, এই একটা বই, যেটা সম্পাদনা করতে গিয়ে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। আমার নিজের একটাই লেখা দিয়েছিলাম (‘Understanding Tigers’), কিন্তু বাকি লেখাগুলো জোগাড় করে, সেগুলোকে দুই মলাটের মধ্যে আনার কাজটা খুব আনন্দের ছিল।

 

  • এই বইতে ফ্রেডেরিক ওয়াল্টার চ্যাম্পিয়নের লেখাটি (‘Photographing Tigers’) আমি পড়েছি। তিনি বাঘকে বন্দুক দিয়ে শুট করার চেয়ে ক্যামেরা দিয়েই শুট করা বেশি পছন্দ করতেন। আপনি যেহেতু ভারতে বাঘশুমারির ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করেন, আপনার কাছে জানতে চাইব, বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়নের অবদান ঠিক কোথায়?

ভারতীয় বন্য বাঘ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম যিনি এগিয়ে এসেছিলেন, তিনি এই ফ্রেডেরিক চ্যাম্পিয়ন। আমি মনে করি, এই ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন চ্যাম্পিয়ন। মনে রাখতে হবে, তিনি দুইয়ের দশকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন ফরেস্ট সার্ভিস অফিসার হিসেবে, যে সময়ে নিয়মই ছিল, ডিএফও (ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার) হলে অন্তত একটা বাঘ মারতেই হবে। তারপর যে যত খুশি বাঘ মারতে পারে। চ্যাম্পিয়ন সাহেব জীবনে ওই একটাই বাঘ মেরেছিলেন নিয়মের ফাঁসে পড়ে। তারপরে আর কোনও বাঘ কখনও মারেননি।

 

তিনি ছিলেন একজন অসামান্য প্রকৃতিবিদ। তিনি হয়তো বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু ভারতবর্ষের বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমি তাঁকে করবেটের চেয়েও উচ্চাসনে রাখব। বাঘকে গুলি করে মারার চেয়ে বাঘেদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা তাঁর কাছে শ্রেয় বলে মনে হয়েছিল। সেই ১৯২০ সালেই তিনি লিখেছিলেন, ভারত থেকে কী ভয়ানক হারে বন্যপ্রাণ কমে যাচ্ছে!

আরও পড়ুন
আমাদের এখানে আলোকসজ্জার বিবর্তনের কথা যদি বলতে হয় সেটা একপ্রকার ছেলেখেলা-দীপক মুখোপাধ্যায়

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
ফ্রেডেরিক ওয়াল্টার চ্যাম্পিয়ন। সূত্র – টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া

যে ক্যামেরাগুলো তিনি ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলো একদম প্রথম যুগের ক্যামেরা। নিউ ইয়র্কের ক্যামেরা প্রস্তুতকারক উইলিয়াম নেসবিট এই ক্যামেরাগুলো তৈরি করেছিলেন। ফোটোগ্রাফির জন্য তাঁরা ম্যাগনেসিয়াম ফ্লেয়ার (ফ্ল্যাশ যন্ত্রের বিকল্প হিসেবে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হত) ব্যবহার করতেন, সেটাকে বাঘের শিকার করা পশুর মৃতদেহের সঙ্গে বাঁধা হত। তারপর শুরু হত বাঘ আসার অপেক্ষা। এইভাবে ৩০ বছরের দীর্ঘ সময়ে ফ্রেড চ্যাম্পিয়ন মাত্র ৯টা বাঘের ছবি তুলতে পেরেছিলেন।

 

পরবর্তীকালে ফ্রেড চ্যাম্পিয়নের নাতি, যাঁর নামটা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না (নাতির নাম জেমস চ্যাম্পিয়ন), তিনি তাঁর দাদুর একটি জীবনী লেখেন, ‘Tripware for a Tiger’। চ্যাম্পিয়ন যেভাবে তাঁর ক্যামেরায় ভারতীয় জীবজন্তুদের নিরীক্ষণ করেছিলেন, তার একটি প্রামাণ্য কাজ এই বইটি। এছাড়া, তাঁর নিজস্ব সংগ্রহ, ইংল্যান্ডে বড়ো হয়ে ওঠা, স্কুলজীবনে লেখা ডায়েরি, এই সমস্ত বিষয়ও স্থান পেয়েছিল বইটিতে। তাঁর নাতির অনুরোধে আমি এই বইটির প্রাককথন লিখেছিলাম। এটা আমার কাছে খুবই বড়ো সম্মান ছিল।

 

  • সত্যিই বড়ো সম্মানের বিষয় এটি। ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতি সম্পর্কে একটি প্রশ্ন করতে চাই। এটি বাঘ গণনার ক্ষেত্রে তো খুবই কার্যকরী। এছাড়া, আর অন্য কী কী ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি কার্যকর হতে পারে?

এই পদ্ধতি তো চ্যাম্পিয়নের সময় থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু ব্যবহারযোগ্য হতে গেলে ক্যামেরাকে হতে হবে সহজলভ্য, যাতে অনেকগুলো এমন ক্যামেরাকে আমরা একটা বড়ো অঞ্চল জুড়ে ফিট করতে পারি। ভালো এবং বেশ দামী ক্যামেরা ট্র্যাপও রয়েছে, যেমন, ট্র্যাম্পিয়ান্স। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতো সংস্থা এই ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করে খুব ভালো ছবি তোলে। কিন্তু কম দামে অনেক ধরনের ক্যামেরা ট্র্যাপই পাওয়া যায়, যেগুলো খুবই সহজলভ্য। সেরকম একটি ক্যামেরা ট্র্যাপ ভারতবর্ষে আমি প্রথম ব্যবহার করি, ১৯৯০ সালে। অর্থাৎ, আজ থেকে ৩১ বছর আগে। সেগুলো দিয়ে একসঙ্গে অনেক ছবি তোলা যায়, বিজ্ঞানের গবেষণায় যেটা বেশি করে দরকার।

 

সেই ছবি ব্যবহার করে আমরা বাঘের সংখ্যা তো বটেই, বেঁচে থাকার পথে তাদের যে ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, সেই তথ্যও জেনে নিতে পারি। এছাড়া, প্রত্যেকটি বাঘকে আলাদা করে চেনার ক্ষেত্রেও ক্যামেরা ট্র্যাপের বড়ো ভূমিকা আছে। শুধু বাঘ নয়, জেব্রা বা লেপার্ড, বা অন্য যেকোনো প্রাণির ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। এরপর আমরা ওই প্রাণিটির পপুলেশন বায়োলজির একটি গাণিতিক মডেল যখন তৈরি করি, ছবি থেকে পাওয়া এই তথ্যগুলো আমাদের খুবই কাজে আসে।

আরও পড়ুন
এক্সক্লিউসিভ: মুখোমুখি হান্নান মোল্লা – বাংলার কৃষকরা এই আন্দোলনে নেই এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
একসময়ে এশিয়ার যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বাঘের বিচরণ ছিল, তা এখনকার প্রায় ৩০টা দেশকে নিয়ে। ছবিসূত্র – ডিসকভারি

এগুলো ছাড়া ক্যামেরা ট্র্যাপের অন্যান্য উপকারিতাও আছে। বেশ কিছু প্রাণি আছে, যাদেরকে দেখাই যায় না। যেমন, সাওলা বা ভু কুয়াং অক্স। এটি খুবই বিরল প্রজাতির একটি অ্যান্টিলোপ। পাওয়া যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (ভিয়েতনামে)। ক্যামেরায় এখনও অবধি মাত্র দুটো কি তিনটে ছবি পাওয়া গেছে। ফলে, কোনও একটি প্রাণিকে খুঁজে বার করার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ট্র্যাপের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। এছাড়া, চোরাশিকারীদের উপর নজরদারি চালানোর ক্ষেত্রেও ক্যামেরা ট্র্যাপ কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। এখানে একটা কথা বলে রাখি। কমদামী ক্যামেরা ট্র্যাপ প্রথম তৈরিই করা হয়েছিল হরিণ-শিকারীদের জন্য। আমেরিকার কানসাসের বিল গুডসন এটি প্রথম তৈরি করেন। ওখানকার হরিণ-শিকারীরা বড়ো বড়ো স্ট্যাগ (পুরুষ হরিণ) শিকারের জন্য এগুলোকে ব্যবহার করত। অতএব, নানা কাজেই এই ক্যামেরা ট্র্যাপ ব্যবহার করা যায়। আমি ব্যবহার করে এসেছি বিজ্ঞানের জন্য।

 

  • চোরাশিকারে নিহত কোনও বাঘ বা অন্যান্য প্রাণির চামড়া যখন পাচার হওয়ার সময়ে ধরা পড়ে, তখনও তো ক্যামেরা ট্র্যাপে তোলা ছবি দেখে সেই প্রাণিটিকে চিহ্নিত করা যায়?

হ্যাঁ, তবে সেটার ব্যবহার হয় ঘটনাচক্রে। আমাদের দেশে এটাকে বড়ো পরিসরে ব্যবহার করার সুযোগই নেই। কারণ, ক্যামেরা ট্র্যাপ কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, সেটা আমাদের দেশের সরকার ঠিকমতো জানেই না। তারা ক্যামেরা কেনে প্রচুর, কিন্তু তাকে কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই।

 

সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অনেক উপকার হতে পারত। অনেক সময়েই চামড়া পাচার হতে গিয়ে ধরা পড়ে, হংকং বা অন্য কোনও জায়গায়। সেখানে আমাদের হাতে যদি সঠিক ডেটাবেস থাকে, তখন সেই চামড়াটা কোন বাঘের, সেটা সহজেই জানা যায়। জীবন্ত বাঘের ছবি আমাদের কাছে থাকলে মরা বাঘের চামড়ার ছবির সঙ্গে মিলিয়ে সহজেই তাকে চেনা যায়। কর্ণাটকে এরকম চার-পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আমরা পাচার হওয়ার সময়ে ধরা পড়া চামড়ার সঙ্গে আমাদের নিজেদের ক্যামেরা ট্র্যাপে তোলা বাঘের ছবি মিলিয়ে দেখে বাঘটাকে চিহ্নিত করতে পেরেছি।

 

  • ভারতে প্রথম ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতির প্রয়োগ এবং প্রথম রেডিও টেলিমেট্রি ব্যবহার, দুটোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আপনার নাম। দুই পদ্ধতির কার্যকারিতার তুলনামূলক দিকটি নিয়ে আপনি যদি কিছু বলেন।

দুটি পদ্ধতির মধ্যে খুব অল্পই ওভারল্যাপ রয়েছে। রেডিও টেলিমেট্রি পদ্ধতির ক্ষেত্রে একটা জীবন্ত বাঘকে প্রথমে ধরা হয়, তারপর তার গলায় কলার পরানো হয়। আগে আমরা যা করতাম, তা হল গ্রাউন্ড ট্র্যাকিং। এক্ষেত্রে আমরা পায়ে হেঁটে, বা গাড়িতে, বা হাতির পিঠে চেপে বাঘটাকে অনুসরণ করি। হাই-ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও ট্র্যাকিং ব্যবহার করা হয়। এটা বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য দেয় না। বরং কোনও একটা বাঘিনী বা বাঘের বিচরণক্ষেত্রটা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া, তারা একে অপরের সঙ্গে কীভাবে সংযোগ স্থাপন করে বা কীভাবে বাচ্চাদের বড়ো করে, এই তথ্যগুলোও জানা যায়।

 

আরও একটি বিষয় জানার জন্য এই পদ্ধতিটি খুবই কার্যকরী। একটা বাঘ যতগুলো শিকার করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে, সেটার সম্পর্কেও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। এই তথ্য থেকে তাদের খাদ্যাভাস সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা সম্ভব হয়, এবং একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘের একবছরে ক’টা শিকারের প্রয়োজন পড়ছে, সেই সম্পর্কেও খুব বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। ফলে, আলাদা আলাদা বাঘের আচরণবিধি সম্পর্কে জানার জন্য রেডিও টেলিমেট্রি খুবই কার্যকরী। ক্যামেরা ট্র্যাপিং থেকে সেই সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।

আরও পড়ুন
A six-month-old fetus baby had been thrown into a dustbin, we have picked it up and did the burial

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
এডওয়ার্ড জেমস ওরফে জিম করবেট। সূত্র – উইকিমিডিয়া কমন্স

গণনার ক্ষেত্রে বরং ক্যামেরা ট্র্যাপ অনেক বেশি কার্যকরী। রেডিও টেলিমেট্রিতে যেমন একসঙ্গে ৫-৬টা বাঘ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, একটা ক্যামেরা ট্র্যাপ বসিয়ে ওই একই সময়ে, ওই অঞ্চলে যত বাঘ রয়েছে, তার প্রায় সত্তর শতাংশকে চিহ্নিত করা যায়। ফলে কোথাও যদি ১০০টা বাঘ থাকে, ক্যামেরা ট্র্যাপে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৭০টা বাঘকে চিহ্নিত করা যাবে। আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করা ছাড়াও বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে জানার জন্য ক্যামেরা ট্র্যাপ অনেক বেশি উপকারী। রেডিও টেলিমেট্রির সময়ে যেসব বাঘকে ধরা যায়নি, ক্যামেরায় তোলা ছবি তাদের খোঁজ দিতে পারে।

 

  • আপনি জিম করবেটের কথা কিছুক্ষণ আগেই বললেন। ভারতের জঙ্গল, জীবজন্তু এবং অবশ্যই বাঘশিকার নিয়ে যে দুজনের লেখা ভীষণ জনপ্রিয়, তাঁরা হলেন জিম করবেট এবং কেনেথ অ্যান্ডারসন। জিম করবেট ছিলেন উত্তর ভারতে, কেনেথ অ্যান্ডারসন দক্ষিণ ভারতে। যদিও তাঁরা মূলত শিকারী ছিলেন, তাও কনজারভেশানিস্টরা তাঁদের যথেষ্ট সম্মান করেন। বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁদের সত্যিই কোনও ভূমিকা আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

ফ্রেড চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁদের সেভাবে কোনও ভূমিকা নেই বললেই চলে। জিম করবেট বহু মানুষের কাছেই অনুপ্রেরণা। কারণ, তিনি বাঘশিকারের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন, এবং সেগুলো সবই ছিল সত্য ঘটনা। বহু মানুষ সেগুলো পড়ে প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী হয়। তবে তিনি কখনোই রক্তপিপাসু শিকারী ছিলেন না। পরবর্তীকালে যুক্তপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে হেইলি জাতীয় উদ্যন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, আমি তাঁকে সংরক্ষণবিদ বলতে পারব না। ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে, তারপরেই তিনি তাঁর বোনকে নিয়ে কেনিয়াতে চলে যান। অবশ্যই তিনি একজন বিরাট মাপের প্রকৃতিবিদ, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, বড়ো লেখক, তাঁর বই পড়লে শুধু বাঘ নয়, অন্য নানা ধরনের জীবজন্তু, পাখি, জঙ্গল সম্পর্কে জানা যায়।

 

কেনেথ অ্যান্ডারসন জন্মেছিলেন ১৯১০ সালে, করবেটের অনেক পরে। তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। আমি যখন ১৯৭১ সালে কলেজ পাশ করি, তখন তাঁর শেষ বয়স। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি নিজের দেখা করতে গিয়েছিলাম, পরে তাঁর সঙ্গে জঙ্গলেও ঘুরেছি। কেনেথ কিন্তু কখনও সংরক্ষণবিদ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাননি। দক্ষিণ ভারতের ভূমিপ্রকৃতি, ন্যাচারাল হিস্ট্রি, পশুপাখি নিয়ে তাঁর বইতে তিনি অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। মানুষ হিসেবে খুব মজার ছিলেন। আমি তখন ২৩ বছরের তরুণ, আর উনি তখন ৬১, কিন্তু সেই পার্থক্যটা বুঝতে দিতেন না। তাঁর বই পড়লে তোমার মনে হবে, তিনি বেশ নিষ্ঠুর শিকারী ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়, যে বিশাল সংখ্যক নরখাদক বাঘ বা লেপার্ডের কথা তিনি লিখেছেন, অত আদৌ বাস্তবে ছিল কিনা সন্দেহ। এমন হতে পারে, এই গল্পগুলো অনেকটা মন থেকেই লিখেছিলেন তিনি। কোনও একজন স্বামীজী কালো যাদু প্রয়োগ করে বাঘে পরিণত হল, এরকম ঘটনা তিনি লিখে গেছেন।

আরও পড়ুন
‘ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশগুলোর মানুষজন পরস্পর মুখোমুখি হলে আসলে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়’- আকিল কুমারাসামি

কেনেথ অ্যান্ডারসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যার আপনি কি সত্যিই ওইসব বাঘগুলোকে মেরেছিলেন?
কেনেথ অ্যান্ডারসন। ছবি – দ্য হিন্দু

কেনেথ অ্যান্ডারসনের বইও যখন কন্নড়ে অনূদিত হয়েছে, সেই লেখাগুলো বহু মানুষকে কিন্তু প্রকৃতি সম্পর্কে উৎসাহিত করে তুলেছে। অর্থাৎ, বলা যায়, এই দুজন নিজেরা কনজারভেশানিস্ট ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের লেখা অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছে, যাঁরা পরবর্তীকালে কনজারভেশানিস্ট হয়েছেন। করবেট তবে সত্যি সত্যিই বাঘগুলোকে নিজের হাতে মেরেছিলেন। যদিও, চম্পাবতের নরখাদকের যে গল্পটা (‘The Champawat Man-Eater’, ১৯০৭ সালে কুমায়ুনের চম্পাবত গ্রামে জিম করবেটের মারা প্রথম নরখাদক বাঘ), সেটা নিয়ে আমার একটু ধোঁয়াশা আছে। আমার মনে হয়, ওটা একাধিক বাঘের কীর্তি। একটা বাঘের পক্ষে চারশোর উপর মানুষ মারা একটু অস্বাভাবিক (হাসি)। সেখানে কেনেথ যে নরখাদকদের কথা লিখেছেন, সেগুলোর অনেকগুলোই কাল্পনিক ছিল বলে মনে হয় আমার।

 

  • আমার পরবর্তী প্রশ্নটাই ছিল, কেনেথ অ্যান্ডারসনের সঙ্গে আপনার কখনও দেখা হয়েছে কিনা (হাসি)। কারণ, উনি ব্যাঙ্গালোরে থাকতেন, আপনিও কর্ণাটকের।

হ্যাঁ, আমি তো সেকথা বললামই। ওঁর সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরেছি। সঙ্গী হিসেবে অসাধারণ ছিলেন, খুব ভালো গল্প বলতে পারতেন। জানো, ওঁকে আমি একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যার, আপনি কি সত্যিই ওই বাঘগুলোকে মেরেছিলেন? (হাসি) উত্তরে উনি বললেন, মাঝে মাঝে গল্পের খাতিরে একটু তো রং চড়াতে হয়। সরাসরি কোনও উত্তর কিন্তু উনি দেননি।

 

(শেষাংশ আগামী বুধবার)

কভারের ছবি সৌজন্যে: কে. উল্লাস কারন্থ; ছবিটি তুলেছেন রামনাথ চন্দ্রশেখর।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: তিষ্য দাশগুপ্ত ও সেন্টার ফর ওয়াইল্ডলাইফ স্টাডিজ

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!