২৫ এপ্রিল, ২০২৪বৃহস্পতিবার

২৫ এপ্রিল, ২০২৪বৃহস্পতিবার

‘আমরা যতই এলেবেলে হই, আমাদের বিজ্ঞানটা যেন কখনোই এলেবেলে না হয়ে যায়’

মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা। দীর্ঘদিনের চর্চিত একটি তার্কিক বিষয়, কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্তত এই বাংলায় তা এখন সোনার পাথরবাটি। আর বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় তো দুটি ক্ষেত্রকেই কেমন কোণঠাসা দেখাচ্ছে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একদল স্বপ্নালু বিজ্ঞানোৎসাহী এগিয়ে এলেন নিজেদের ভাবনা নিয়ে। অতিমারীর চোখরাঙানি-লকডাউন, এসবের মাঝেই ডিজিট্যাল মাধ্যমে খুলে ফেললেন একটি প্ল্যাটফর্ম। নামটি বেশ অদ্ভুত। ‘এলেবেলে’। এই নামের পেছনেও অবশ্য রয়েছে এক উন্নততর, বৈজ্ঞানিক সমষ্টি-ভাবনা। অবলীলায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ‘দুরূহ’ কাজটি। তাঁদের কাছে অবশ্য তেমন দুরূহ নয়, আসলে তাঁরা যে স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন। বিজ্ঞান-সম্বন্ধীয় দীর্ঘ প্রবন্ধ, গল্পই হোক বা বিজ্ঞানের টুকিটাকি, লেখা প্রকাশিত হয় সম্পূর্ণ বাংলায়। তাঁদের পরিচিতির পাতাটিও সাজানো আছে ‘দুঃখিনী বর্ণমালায়’। একটি পরিভাষা তৈরির কাজও নিজেদের উদ্যোগে শুরু করেছেন তাঁরা। ইতিমধ্যেই বহু মানুষের ভালোবাসা, পাশে থাকার অঙ্গীকার পেয়ে গিয়েছে ‘এলেবেলে’। জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের প্রাক্কালে দুই এলেবেলে চিরশ্রী লাহিড়ীপ্রত্যয় ঘোষ মনখোলা আড্ডা দিলেন ‘ভিন্নসময়’এর প্রতিনিধি সোহম দাসের সঙ্গে।

  •  ‘এলেবেলে’ তৈরির ভাবনা কীভাবে এল?

প্রত্যয়: ভারতে লকডাউন যখন চলছে, ওই সময়ে ফেসবুকে দেখতাম অনেকেই করোনা-সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক কিছু লিখছে। যেমন, আমাদের নির্মাল্য (‘এলেবেলে’র অন্যতম সক্রিয় সদস্য নির্মাল্য দাশগুপ্ত), বর্ষণজিত মজুমদার, আর্য মিত্র, এক নম্বর অর্কব্রত গুপ্ত (‘এলেবেলে’র সদস্য) এরা। এক নম্বর বলার কারণ, আমাদের দু’জন অর্কব্রত গুপ্ত আছে। একজন পদার্থবিদ্যার, একজন রাশিবিজ্ঞানের। আমি বলছি পদার্থবিজ্ঞানের অর্কর কথা (হাসি)। এই এক নম্বর অর্ক আর অর্চিষ্মান মহাপাত্র বলে একটি ছেলে, সে জীববিদ্যার, এরা দুজন নির্মাল্যর ফেসবুক পোস্টের কমেন্ট বক্সে লেখে, আমরা বাংলায় এরকম কিছু একটা করতে চাই। ওরা নিজেদের মধ্যে প্রথম এইভাবে কমিউনিকেট করে। সেই প্রাথমিক কথার পরে অর্চিষ্মান, যে কিনা আমার আত্মীয়, সে আমাকে পরিকল্পনার কথা বলে। এরপর নির্মাল্যকেও বলা হয়। এটা ধরো, মোটামুটি গতবছর জুন মাস নাগাদ। আমরা সকলে মিলেই ঠিক করি যে, কিছু একটা করতে হবে আমাদেরকে, এবং আমাদের সকলের চিন্তাভাবনাটাই এক হয়ে যায় যে, আমরা মানুষজনকে বিজ্ঞানের সম্পর্কে সচেতন করে তুলব, এবং সচেতনতা বাড়ানোর সেই কাজটা আমরা বাংলাতেই করব। এই ভাবনাটা আমাদের প্রত্যেকের মনে আগে থেকেই ছিল, শুধু যোগাযোগটা কোনোভাবে ঘটে যায়।

তারপর, জুনের পর থেকে অনেকগুলো মিটিং করি আমরা। কীকরে পরিকল্পনা ছকা যায়, কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়, এই ভাবনাগুলো ভাবতে থাকি আমরা। তখনও ‘এলেবেলে’-র নাম ‘এলেবেলে’ ছিল না। তখন আমরা ‘বাংলায় বিজ্ঞান’ বলে একটা গ্রুপ খুলেছিলাম হোয়াটসঅ্যাপে। সেই গ্রুপে ক্রমাগত আলোচনা চলতে চলতে শেষমেশ যখন মোটামুটি অগাস্ট মাস, তখন আমরা খুঁজতে শুরু করি আরও যদি সমমনষ্ক কিছু লোকজনকে পাওয়া যায় এবং তাদেরকে নিয়ে আসা যায়। সেই সময়েই চিরশ্রীর সঙ্গে অর্ক যোগাযোগ করে।

আরও পড়ুন
অপারেশনের সময়ে হাতিটির আক্রমণে আমার শ্যালক নিহত হন, তারপরেও আমি ওদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি

‘আমরা ‘এলেবেলে’। কারণ, খুব গুছিয়ে, প্ল্যান করা নয়, আমরা কোনও কর্পোরেট নই।’

চিরশ্রী: অর্ক আসলে আমার জুনিয়র। ‘এলেবেলে’ নামটা যখন হয়েছে, তখনও আমি ‘এলেবেলে’তে ঢুকিনি। আমার দিক থেকে গল্পটা যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে যে, আমি একটু আধটু বাংলায় লেখালেখি করতে ভালোবাসি। এবং সত্যি কথা বলতে কী, বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় লিখতে অতটা স্বাচ্ছন্দ্যও নই। এবার করোনার কালে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে, বাড়িতে বসে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। অন্য সময়ে বিভিন্ন কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ওই সময়ে বিশেষ করে যে জিনিসটা আমি দেখতে পেলাম, সেটা হল, সবকিছু নিয়ে লোকজনের এত ভুল ধারণা, যেমন করোনা নিয়ে হাজারটা গুজব রটছে। যেমন, কেউ বলছে, একঘণ্টা রোদে দাঁড়ালে করোনা চলে যাবে, কেউ বলছে, অ্যালকোহল খেলে করোনা চলে যাবে। এবার ধরো, আমি একটা জিনিস বললাম কাউকে যে, এটা ভুল কথা, এটা ঠিক কথা না, এটা গুজব, কিন্তু সবকিছু তো ধরে ধরে বলতে পারব না। সেজন্য যেটা দরকার, সেটা হল, সে নিজেই যেন বুঝতে পারে যে, এটা হল গুজব আর এটা সত্য, অর্থাৎ সঠিক বোধের জায়গাটা। স্পুনফিডিংটা যেন করতে না হয়।

প্রায় বছরখানেক আগে, তখন আমি শিবপুরে পোস্ট ডক্টরেট করছি, অর্ক একদিন ক্যান্টিনে খেতে খেতে আমায় বলেছিল, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আমার কিছু একটা করার ইচ্ছে আছে। একটা ইউটিউব চ্যানেল খোলার ইচ্ছে আছে। আমি বলেছিলাম, খুবই ভালো। যদি তোমরা এটা নিয়ে এগোনোর কথা ভাবো, তাহলে অবশ্যই আমায় ডেকো। আমার যতদূর মনে পড়ছে, জুলাই মাসে অর্ক এটা নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ও বলে যে, এটা মূলত একটা ওয়েবসাইট হবে, যেখানে থাকবে কিছু লেখালেখি, এবং বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু ভিডিও নিয়ে একটা ইউটিউব চ্যানেল। তখন আমিও ফেসবুকে লিখছি যে, এটা গুজব, এটা বিজ্ঞানমনষ্কতা নয়। আমার মনে হল, একটা প্ল্যাটফর্মে যদি এটা দিই, তাহলে স্বরটা অনেক বেশি হবে এবং অনেক লোকের কাছে গিয়ে পৌঁছবে।

আরও পড়ুন
সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।

‘আমরা ‘এলেবেলে’, কিন্তু একটু অন্যভাবে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায়, আমরা ‘এ লেভেলে’’

  • এলেবেলে কথাটা আমরা মূলত ব্যবহার করি হেলাফেলা অর্থে। কিন্তু তোমরা যে কাজটা করছ এবং যেভাবে করছ, সেটা তো মোটেই হেলাফেলার বস্তু নয়। তাহলে এমন একটা নাম পছন্দ করার পিছনে আলাদা করে কোনও উদ্দেশ্য কি আছে?

প্রত্যয়: (হাসি) নামটা আসলে আমারই দেওয়া। ‘বাংলায় বিজ্ঞান’, ‘জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা’, বিজ্ঞান অমুক, বিজ্ঞান তমুক, এরকম নাম দেওয়াই যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, আমি যখনই ওটাকে বলে দেব যে, ওটা বিজ্ঞান, তখনই মানুষের মধ্য এক ধরনের প্রেজুডিস চলে আসবে যে, এরা কঠিন, গভীর কথাবার্তা বলবে। দ্বিতীয়ত, আমি যদি লোককে গিয়ে বলি যে, আমি বিজ্ঞানের চ্যানেল খুলেছি এবং আমি একজন খুব পণ্ডিত একজন মানুষ, আমি যা বলব, তোমরা এসে শুনবে, সেই জিনিসটাও খুব খারাপ। কারণ, বিজ্ঞান তো কোনও অথরিটির বিষয় নয়। আমি বলে দিলাম এটা ঠিক তো এটাই ঠিক, এরকম কোনও বিষয় নয়। এরকম ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আমাদের মনে হয়েছিল যে, ‘বিজ্ঞান’ শব্দটা বাদ দিয়ে আমরা যদি একটা ক্যাচি নাম দিই, তাহলে অনেক লোক আসবে এবং আমাদের উদ্দেশ্যটাও সফল হবে। সেরকমই অনেকগুলো নামের তালিকা তৈরি করা হয় এবং আমিই শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব করি যে, নামটা ‘এলেবেলে’ দেওয়া হোক। এটা বোঝাতে যে, আমরা গোছানো নই, এলোমেলো। আমরা সিরিয়াস কাজ করছি, কিন্তু এটা করছি প্যাশন থেকে। খুব গুছিয়ে, প্ল্যান করা নয়, কারণ আমরা কোনও কর্পোরেট নই। এরকম একটা ভাবনা থেকেই নামটা দেওয়া। পরে এটার একটা ইন্টারপ্রিটেশন দিয়েছিল অর্চি বা অর্ক। সেটা হচ্ছে, আমরা ‘এলেবেলে’, কিন্তু একটু অন্যভাবে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায়, আমরা ‘এ লেভেলে’ (হাসি)। মানে, আমাদের লেভেলটা খুব খারাপ নয়। আমরা যে বিজ্ঞানটা বলব, সেটা ভালো বিজ্ঞানই বলব।

চিরশ্রী: আমি তো বললামই যে, আমি নাম ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে যোগ দিয়েছিলাম। আমাকে অর্ক এসে বলেছিল যে, দিদি আমরা নাম ঠিক করেছি ‘এলেবেলে’, ‘এ লেভেলে’। এটা শোনার পর প্রথম ঝটকায় আমার একটা ভালো লাগা তৈরি হয়ে যায়। কারণ, এখানে কিন্তু একটা ভিড়ে মিশে যাওয়ার মতো ব্যাপার রয়েছে। এখানে যারা রয়েছি, ধরো কেউ রিসার্চ করছি, কেউ কলেজে পড়াচ্ছি, এছাড়া, প্রচুর স্টুডেন্ট আছে। সেই লঘু-গুরু ব্যাপারটা এখানে নেই। আমি ম্যাডাম, বা উনি স্যার, ও ছাত্র বা ছাত্রী, সেই বিষয়টা নেই। আমরা যেমন এমনি ভিড়ের মধ্যে মিশে আড্ডা মারি, বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলি, বাড়িতে বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলি, সেইভাবে ক্যাজুয়ালি তাদের কাছে আমি পৌঁছচ্ছি। ঠিক যেন, আমিও এলেবেলে, তুমিও এলেবেলে। অনেক সময়ে ছোটরাও আমাদের বকে দেয়, যদি কিছু ভুলত্রুটি ঘটে। যার যা দায়িত্ব, সেটা তারই।

প্রত্যয়: আমাদের গ্রুপেও কিন্তু এই মনোভাবটা ধরে রাখা হয়। সেখানেও কোনও হায়ারার্কি নেই। তুমি যদি আমাদের ওয়েবসাইটেও যাও, দেখবে আমাদের নামের আগে কোনও ডক্টর, প্রফেসর এসব লেখা নেই। আমরা বরং লিখি এলেবেলে প্রত্যয়, এলেবেলে চিরশ্রী। সবাই সমান এখানে।

আরও পড়ুন
ভিন্নসময় এক্সক্লুসিভ: ‘২৬ জানুয়ারি যা ঘটেছে তা পুরোপুরি ষড়যন্ত্র ছিল’– কৃষক নেতা রামিন্দর সিং পাটিয়ালা

এলেবেলে প্রত্যয়

  • বিজ্ঞান-ভিত্তিক লেখা তো নানারকমের হতে পারে। সরস প্রবন্ধ হতে পারে, গভীর আলোচনামূলক হতে পারে আবার কোনও একটি বিষয়কে কাউন্টার করতেও শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক লেখার প্রয়োজন পড়ে। ‘এলেবেলে’তে মূলত কী ধরনের লেখা তোমরা প্রকাশ করো?

চিরশ্রী: প্রথমত, আমাদের বাড়ির লোকজন, যারা টিপিক্যাল বিজ্ঞানের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত নন, তাঁরা ভাষার কারণে বা অন্যান্য কারণে কোনটা বিজ্ঞানের আসল খবর আর কোনটা গুজব, সেটা চট করে বুঝতে পারেন না। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য তাই ছিল মূলত আমাদের বাবা-মা’দের বোঝানো। ফলে, যে লেখাগুলো আমরা লেখার চেষ্টা করি, সেগুলো একটু গল্পের আদলে থাকে। অনেক সময়ে সামান্য ড্রামাটাইজও করি। এখানে একটা ব্যাপার আছে, আমরা যতই এলেবেলে হই, আমাদের বিজ্ঞানটা যেন কখনোই এলেবেলে না হয়ে যায়। বিজ্ঞানের যে তথ্যগুলো দিই, আমরা নিজেদের দিক থেকে চেষ্টা করি, সেটা যেন কখনও জোলো না হয়ে যায়। যে কারণে আমরা প্রবন্ধটাই বেশি লিখি। এছাড়া, বেশ কিছু গল্প আর নাটক আছে। আর দ্বিতীয় একটা সেগমেন্ট আছে, যেটা হচ্ছে বিজ্ঞানের খবর। সেটা সাধারণত একটু বিষয়ভিত্তিক হয়। এখন যা যা গবেষণা হচ্ছে, তার উপর আমরা কিছু লেখালেখি করি। সেখানে আবার অনেক সময় দেখা যায়, বাজারচলতি কিছু ভুল তথ্য আমাদের কাছে চলে আসে। কারণ, এখন তো সবটাই অনলাইনে বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ছড়ায়। ফলে, ভুল তথ্য চলে আসেই। সেই জিনিসটা যে ভুল, সেটা যুক্তির মাধ্যমে দেখিয়ে সঠিক ইন্টারপ্রিটেশন দিয়ে লেখারও চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন একটা লেখা আছে, ‘করোনা ভ্যাক্সিনে কি ক্যান্সার সারে?’ এটা নিয়ে বেশ কিছু লোকের মধ্যে একটা গুজব উঠেছিল। আসল ঘটনাটা ঠিক কী, সেটা লোকে বুঝতে পারছিল না। তখন সেটাকে ঠিক কাউন্টার বলব না, কিন্তু সঠিক খবরটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

  • আমি এবার একটু ‘এলেবেলে’র বাইরে একটা প্রশ্ন করছি। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আমরা সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। বাংলায় একসময়ে খুবই ভালো বিজ্ঞানের বই লেখা হয়েছে। জগদীশ বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এছাড়া, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, এমন নানা বিখ্যাত লেখকরা সহজ বিজ্ঞানের লেখা লিখে গেছেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সেই পরিসরটা আস্তে আস্তে নিভে এল। সেটার কী কারণ থাকতে পারে বলে তোমাদের মনে হয়?

প্রত্যয়: এটা খুবই ভালো একটা প্রশ্ন এবং এটা নিয়ে বেশ কিছুদিন কিছু লোকের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি চলছে। আমার যেটা মনে হয়, প্রথমত, এটা একটা পোস্ট-কলোনিয়াল হ্যাংওভার। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির না জেতা। অবশ্য তাহলে হয়তো সবকিছু আমরা জার্মানে করতাম। যাইহোক, আসল কথা হচ্ছে, ইংরাজিটা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে, এটা একটা কমিউনিকেটিং ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে গেছে। বাংলায় কথা বলার সময়েও আমাদের কথার মধ্যে ইংরাজির টান চলেই আসে। এছাড়া আমাদের কর্মজীবনেও আমরা বেশিরভাগ সময়ে যেহেতু ইংরাজিতেই কথা বলছি, ফলে, শব্দের এই ব্যবহারটা এসে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এটা কখনোই হতে পারে না যে, আমি বিজ্ঞানচর্চাটাকেই সম্পূর্ণ ইংরাজিতে করব। এটার কোনও মানে নেই। আমি যদি দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, জার্মানি, ফ্রান্স, চীন বা জাপানের দিকটা দেখি, তারা কিন্তু চর্চাটা নিজেদের ভাষাতেই করে যাচ্ছে। এটা আসলে ভারতীয় কিছু ভাষা এবং যেখানে ঔপনিবেশিক প্রভাবটা রয়ে গেছে, সেইসব জায়গাতেই এই ব্যাপারগুলো হয়।

আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি যখন পিএইচডি করেছি, তখন আমি আমার সুপারভাইজারের সঙ্গে দিনের পর দিন হিন্দিতে বাক্যালাপ করে গেছি। কারণ হচ্ছে, দুটো ভাষা, যে দুটোতে আমরা কমিউনিকেট করতে পারি, তাই সেই দুটো ভাষাতেই আমরা কথা বলি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এও বলছে যে, আমি যখন জার্মান স্টুডেন্টকে দেখছি, তারা কিন্তু জার্মানেই কথা বলছে। তাদের দরকারই পড়ছে না ইংরাজিতে কথা বলার। এবার পয়েন্টটা হচ্ছে, আমি সেটাকে কমিউনিকেট করব কীভাবে? সেটা আমার মনে হয়, ইংরাজিতে কমিউনিকেশন স্কিলটা একটু থাকা দরকার। কিন্তু আমি যদি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার কথা বলি, তাহলে সেখানে তিনখানা স্টেজ পাব। প্রথমটা হচ্ছে, শিশুদেরকে আমি কীভাবে বোঝাব। দ্বিতীয়, সাধারণ মানুষকে আমি কীভাবে বোঝাব। তৃতীয় হচ্ছে, একজন বিশেষজ্ঞকে আমি কীভাবে বোঝাব। বিশেষজ্ঞকে বোঝাতে গেলে তখন কিন্তু ইংরাজির প্রশ্নটা এসে যায়। কারণ, বিশেষজ্ঞ ছড়িয়ে আছেন পৃথিবীর সমস্ত জায়গায়। তাঁদের সংখ্যাও খুব কম। তাঁদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে গেলে আমাকে একটা কমন কমিউনিকেটিং ল্যাঙ্গুয়েজ নিতেই হবে। সেটা ফ্রেঞ্চ, জার্মান যা কিছু হতে পারে। কিন্তু আমি যদি ভাবি, আমি একটা বাচ্চাকে বোঝাব, বা একটি সাধারণ মানুষকে বোঝাব, সেক্ষেত্রে আমাকে বাংলাই ব্যবহার করতেই হবে, যদি না সেই লোকটি একটি ইংরাজি ভাষাভাষীর দেশ থেকে আসে। বাঙালি একটি লোককে প্রথমেই ডেকে নিয়ে আমি যদি নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটা ইংরাজিতে বলে দিই, সে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারবে না। বই আর সেভাবে লেখা হচ্ছে না, পরিভাষা নেই, সেগুলো খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, তেমন ব্যাপার নয়। সেটা অবশ্যই সম্ভব। এর পিছনে একটা পরিশ্রম দিতে হবে, এবং সেই পরিশ্রমটা দিলে অবশ্যই সাফল্য আসবে। পৃথিবীতে এমন কোনও ভাষা নেই, যাতে বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন
প্রজাতন্ত্র দিবস স্পেশাল: কৃষকরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, যদি লড়তেই হয় তবে একজোট হয়ে লড়াই ভালো

এলেবেলে চিরশ্রী

  • বাংলায় এই চর্চাটা যে কমে এল, সেটার সঙ্গে নব্বই দশকের পরবর্তী সময়ের যে বিশ্বায়ন উদার অর্থনীতি, তার কোনও যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়?

প্রত্যয়: সেই রাজনীতিটার কথা আমি বলব না কারণ, সেটাতে একটা বিতর্ক তৈরি হতে পারে। আমি এটাকে এভাবে দেখি যে, তুমি যে সময়টার কথা বলছ, সেই সময়টা হচ্ছে ইন্টারনেট বুম করার যুগ। সেটা ছিল হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে দেখা একটা বিপ্লব, যেটা আমরা কখনও ভাবতেই পারিনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে বলে। এটার ফলে যে বিশ্বায়নটা হয়েছে, তার ফলে বাংলা ভাষা একটু হলেও পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু এটার অনেক ভালো দিকও আছে। বাংলাটা যে পিছিয়ে পড়েছে, সেটা কিন্তু বাঙালিদের জন্যই। তারা ধরে নিয়েছে, ইন্টারনেটে যখন আমি ইংরাজিতে পড়তে পারছি, গ্লোবালাইজ হতে গেলে আমাকে যখন ইংরাজিতে কথা বলতে হবে, আমি ভাষাটাকেই বাদ দিয়ে দিই। অন্যদিকে আমি যদি ফরাসীদের দেখি, তারা যেটা করেছে, সেটা হল এরকম। ইন্টারনেট এসেছে, খুব ভালো কথা, অমুকের ওই বইটা ভালো, এটাকে এখুনি ফরাসীতে অনুবাদ করো। বা ওই সিনেমাটা বেরিয়েছে, এটাকে এখুনি ফরাসীতে ডাব করো। এই জিনিসগুলোও কিন্তু ঘটেছে। বাংলাতে সেটা হল না। বাংলা যদি প্রান্তিক হয়েই থাকে, সেটা সম্পূর্ণভাবে বাঙালিদের দোষেই প্রান্তিক হয়েছে।

  • আমি খুব সম্প্রতি বাংলাদেশের জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের লেখক মহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা পড়লাম বাংলায় বিজ্ঞান লেখা নিয়ে। সেখানে তিনি বলছেন যে, বাংলায় কবিতা লেখা যতটা সহজ, বিজ্ঞান লেখা ততই কঠিন। কারণ, বৈজ্ঞানিক পরিভাষার অভাব। তোমরা যেহেতু এই বিষয়টা নিয়ে বর্তমানে কাজ করছ, তোমাদের মত জানতে চাইব।

প্রত্যয়: পরিভাষার অভাব কারণ পরিভাষা তৈরি করা হয়নি। আমাদের ‘এলেবেলে’-র তরফ থেকে পরিভাষা তৈরি হয়েছে। আমরাই করেছি। এস. এন. বোস একটা সময়ে বিজ্ঞানের পরিভাষা নিয়ে যথেষ্ট পরিশ্রম করে কাজ করেছিলেন। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে বেরোত একটা সবুজ রঙের বই, যেটার মুখবন্ধ তিনি লিখেছিলেন। কিন্তু তারপরে আর এই কাজটা এগোয়নি। এদিকে বিজ্ঞান তো আর থেমে নেই, বিজ্ঞান এগিয়েছে। বিজ্ঞান তার মতো করেই ভাষা বানিয়ে নিয়েছে ইংরাজিতে। কিন্তু সেটাকে অনুবাদের লোক আর পাওয়া যায়নি। এটা সম্ভব নয়, এটা আমি মনে করি না।

চিরশ্রী: লোকে ভাবছে, আমাদের ইংরাজি দিয়ে কাজটা চলে যাচ্ছে। তাই আর অনুবাদ করার ভাবনাটা কেউ ভাবছে না। তারা ভাবছে, আমরা আর আলাদা করে করব কেন? এটার তো আর আলাদা করে যুক্তি নেই। আমি যদি অনুবাদ করি, সেই ভাষাটার ব্যবহারও থাকবে।

প্রত্যয়: আমরা কিন্তু এটা সক্রিয়ভাবে শুরু করেছি এবং কাজটা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা যখন পুরো বাংলাতেই লেখাটা লিখি, তখন শুধু বাংলা পরিভাষাটাই ব্যবহার করি। এবার যখন দিচ্ছি না, তখন সেই পরিভাষাটা এমনভাবেই দিই যাতে লোকে বুঝতে পারে, আমরা ইংরাজি টার্মিনোলজিটা দিচ্ছি না মানে এটা নয় যে, কেউ সেটা বুঝতে পারবেন না। আমরা যদি কঠিন বিষয়ের কথা বলি, সেক্ষেত্রে আমাকে সহজ করে বলতেই হবে। তাকে সংজ্ঞাটা পড়তে হবে, শব্দটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি যেটাকে ‘প্রতিসরণ’ বলছি, সেটাকে ‘কলা’ বললে সেটা তো আর পাল্টে যাবে না। বিষয়টা তো একই। আমাকে বোঝাতে হবে যে, ‘কলা’ মানে হচ্ছে, আলোটা এখান দিয়ে ঢুকে বেঁকে যাবে।

এবার পরিভাষার ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটা ওঠে যে, সঠিকভাবে সেটাকে বানাতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা যে পন্থাটা নিই, সেটা হল, ইংরাজি শব্দটাকে নাও, তারপর সেটার ব্যুৎপত্তি কীভাবে হচ্ছে, সেটা দ্যাখো। ইংরাজির কোন শব্দ থেকে বা ল্যাটিনের কোন শব্দ থেকে সেটা কীভাবে এসেছে, সেটা দ্যাখো। এবার সেটা যখন ওই ব্যুৎপত্তির জায়গায় পৌঁছে যাবে, তুমি তখন ল্যাটিনের সঙ্গে বাংলা তৎসম শব্দের একটা মিল পেয়ে যাবে। ফলে, একটা তৎসম পরিভাষা তুমি বানাতেই পারবে। সবসময়ে যে তৎসমই বানাতে হবে, এমন নয়। কখনও কখনও দেশীয় ভাষাতেও বানানো যায়। সেটা একটু চাপের, তবে অসম্ভব নয়। আমরা সেই চেষ্টাটা চালাচ্ছি, এবং আমাদের ওয়েবসাইটে একটা পেজও রেখেছি। নতুন পরিভাষা তৈরি করলেই সেখানে গুঁজে দিই। একটা অভিধানই বানাচ্ছি বলতে গেলে।

আরও পড়ুন
  ‘ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশগুলোর মানুষজন পরস্পর মুখোমুখি হলে আসলে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়’- আকিল কুমারাসামি

‘যাঁরা ফেসবুক করেন না, তাঁদের কাছে লেখাগুলোকে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটা ভাবতে গিয়েই ম্যাগাজিনের ভাবনা’

  • ওই প্রবন্ধেই জাফর ইকবাল এটাও বলছেন যে, উনি ‘আধান’-এর বদলে ‘চার্জ’, ‘বিভব’-এর বদলে ‘পোটেনসিয়াল’ বা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-র বদলে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ লিখতেই পছন্দ করেন। কারণ, তাঁর মত হচ্ছে, পরবর্তীকালে ছাত্রছাত্রীরা যখন বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, সেখানে তো ইংরাজি প্রতিশব্দেই শিখতে হবে, সেগুলো আগেই বাংলা লেখার মাধ্যমেই শিখে নেওয়া ভালো। ওঁর প্রতি সম্মান রেখেই আমি বলছি, এটা কি কোনোভাবে বাংলার সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরছে না? তোমাদের কী মনে হয়?

চিরশ্রী: ওই একই কথাই বারবার উঠে আসে। আমরা যদি আগে থেকে ধরেই রাখি যে, আমরা এটাকে ‘চার্জ’ বলেই ভাবব, কখনোই ‘আধান’ ভাবব না, সেটা তো আমার নিজের সমস্যা। আমাকে তো নিজের দরজাটাও খুলতে হবে। সেই দায়টা তো আমি অন্য কারও ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না।

প্রত্যয়: আর উচ্চশিক্ষার যে প্রশ্নটি উনি তুলছেন, আমার মনে হয় না এটা কোনোভাবেই খুবই ভাবনার বিষয়। আমি জানি, একটা তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে। এবার দুটো আধানকে কাছাকাছি আনলে আকর্ষণ, বিকর্ষণ করবে, সেটাকে আমি ‘আধান’ বললেই বা কী, আর ‘চার্জ’ বললেই বা কী। কিছুই তো এসে গেল না। সবসময়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমি বিষয়টার সংজ্ঞাটা জানি কি জানি না।

  • বর্তমানে আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে বাংলা নিয়েও একটা গেল-গেল রব উঠেছে এবং বিজ্ঞানকে তো খুবই বিপন্ন দেখাচ্ছে। ফলে, তোমরা যে চর্চাটা শুরু করেছ, সেটা একটা সময়ের দাবী মেনেই। তোমাদের কাজকে মানুষ নিচ্ছেন কীভাবে?

চিরশ্রী: এত কম সময়ের মধ্যে এত ভালো সাড়া যে পাব, সেটা কিন্তু আমরা ভাবিনি। আমরা তো অগাস্ট থেকে শুরু করেছি, তাতেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গার এবং বিভিন্ন বয়সের লোক, বাচ্চা থেকে শুরু করে গবেষক, বয়স্ক লোক, সকলের মধ্যেই খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। এখানে আমাদেরকে অনেকেই অনেকভাবে সাহায্য করবেন বলে এগিয়ে এসেছেন। কিছুদিন আগেই আমরা ‘এলেবেলে’-র একটা অ্যাপ লঞ্চ করেছি। প্রত্যয় সেটা নিজেই খেটেখুটে বানিয়েছে। কিন্তু আমরা তো সেই অর্থে টেকনোলজিতে খুব এক্সপার্ট নই। সেজন্য হয়তো সেটা অতটাও প্রফেশনাল সফটওয়্যারের মতো দেখতে হয়নি। সেখানে কিন্তু লোকে নিজে থেকে এগিয়ে এসেছে সাহায্য করতে। এটাতে তো অন্য কারও কোনও স্বার্থ নেই। শুধুমাত্র ‘এলেবেলে’কে ভালোবেসে কিন্তু অনেক লোক পাশে এসেছে।

তুমি অন্য যে বিষয়টা বললে যে, বাংলা এবং বিজ্ঞান এই দুটোই খুব খাঁড়ার ওপর ঝুলে আছে, সেক্ষেত্রে কিছু লোক তো সেরকম থাকবেই। সে যদি তুমি বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ আইনের সেই সিগনেচার ক্যাম্পেনেরই কথা বলো, সেখানে যদি দুই দলের সইয়ের সংখ্যাটাই দেখো, তাহলেই বুঝবে। এটা তো থাকবেই। এখানেও সেরকম লোক আছে। তাদেরকে এড়িয়ে যতটা ভালো করে কাজটা করা যায়।

প্রত্যয়: হ্যাঁ, এই কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কাজটা কিন্তু আমরা করি সবসময়েই। কদিন আগেই আমি ফেসবুকে এটা নিয়ে লিখেছিলাম। ফেক নিউজ, ট্রোল, এদের সংখ্যা তো কম নয়। সেই ব্যাপারটা কিন্তু আমরা সবসময়ে নজরে রাখি। গণ্ডগোল দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।

চিরশ্রী: শুধুমাত্র পেজে লাইক বাড়ানো হবে বলে সবরকম জিনিসকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে, এই ব্যাপারটা আমরা একদমই করি না।

  • তোমরা সম্প্রতি ‘এলেবেলেস্কোপ’ বলে একটি ই-পত্রিকা করেছ। সেটার ভাবনা এবং সাড়া পাওয়া নিয়ে কিছু শুনতে চাইব।

চিরশ্রী: এটা প্রকাশ করার কারণ হচ্ছে, সবাই তো ফেসবুক করে না। এখনও যেহেতু আমাদের ওয়েবসাইটে লেখার লিঙ্কগুলো ফেসবুকের মাধ্যমেই বেশিরভাগ লোক পড়তে পারে, এছাড়া, আমাদের ছোট ছোট ‘তাই নাকি!’-র সিরিজটা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে মানুষ পড়েন, যাঁরা ফেসবুক করেন না, তাঁদের কাছে এগুলোকে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটা ভাবতে গিয়েই ম্যাগাজিনের ভাবনা। এই ভাবনা মূলত অর্কর ছিল। ওরা বলেছিল, একটা পিডিএফ বানানো হোক। আমাদের দু-তিনমাস পুরনো যে লেখা এবং ‘তাই নাকি!’ গুলোর সংকলন যদি করা হয়, তাহলে সেগুলো হারিয়েও যাবে না, একটা রেজিস্টার্ড পিডিএফের মধ্যে থেকে যাবে।

প্রত্যয়: ম্যাগাজিনটা যেহেতু অফলাইন করা হয়েছিল, তাই সেটায় কেমন সাড়া পাওয়া গেছে, সেটার সম্পর্কে বলাটা কঠিন। আমাদের টেলিগ্রামের যে গ্রুপটি আছে, সেখানে যেটুকু আমরা দেখেছি, সব সদস্যরাই দেখেছে। তারপর ওখান থেকে কোথায় ফরোয়ার্ড হয়ে গেছে, সেটা আর আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে এরকম ঘটনাও ঘটেছে যে, লোকে ফেসবুক থেকে আমাদের লেখা কপি করে সেটাকে হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড বানিয়ে দিয়েছে। এটা খুব ভালো বিষয় যে, হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডে ফেক নিউজের বদলে ভালো কিছু যাচ্ছে (হাসি)।

আরও পড়ুন
গান শোনার অভ্যাস থেকেই আমি ভাবলাম, সঙ্গীতকে আমি যদি ছবিতে আনতে পারি- সমীর আচার্য

‘এলেবেলে’র ভীষণ জনপ্রিয় ‘তাই নাকি!’ সিরিজ। সহজে ব্যাখ্যা দেওয়া বিজ্ঞানের টুকিটাকি পাঠকের আগ্রহ বাড়ায়

  • এই মুহূর্তে ‘এলেবেলে’ নিয়ে তোমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী কী আছে?

প্রত্যয়: ফেসবুকে একটা ভালো পরিচিতি আমাদের তৈরি হয়ে গেছে। এবার আমরা চাইছি, অন্যান্য যে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো আছে, ট্যুইটার, ইউটিউব, সেগুলোতে নিজেদের পরিচিতি বানাতে। ইউটিউবের দিকটা চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে আমাদের মধ্যে ভালো ভিডিও-মেকার সেই অর্থে নেই। সেই কারণে ইউটিউবে আমরা এখনও সেই পুশটা দিতে পারছি না। আমরা লোক খুঁজছি, যারা এরকম ভিডিও বানাতে পারবে। সেক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, যেভাবে আমরা লেখাগুলো দিচ্ছি, সেভাবে আমরা বিজ্ঞানের খবরগুলো ভিডিওর মাধ্যমে দিতে পারি। বা কোনও মজাদার তথ্য দিতে পারি। আরেকটা খুব ভালো আইডিয়া আছে আমাদের। সেটা হল, এই গ্রুপ থেকে আমরা যদি কোনও তথ্যচিত্র বানাতে পারি। ট্যুইটারেও একইভাবে কাজ করার ইচ্ছা আছে। অনলাইন সেক্টরে এই ধরনের পরিকল্পনা আছে।

অফলাইনেও আমরা পরিচিতিটা বাড়াতে চাইছি। আমাদের পরিকল্পনাটা হচ্ছে, বিভিন্ন স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সঙ্গে একটা করে সেশন করব। ইতিমধ্যে একাধিক স্কুল আমাদেরকে নিজেরাই জানিয়েছে যে, তোমরা এসো। আমাদের স্টুডেন্টদের সঙ্গে কথা বলো, তাদের প্রশ্নের উত্তর দাও। প্রথমত, তাদের এটা বোঝাও যে, পেশা হিসেবে বিজ্ঞান কীরকম। সবাই তো চায় ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হতে। বা তারা যদি দেখতে পায় চোখের সামনে যে, আমি একজন সায়েন্টিস্টের সঙ্গে কথা বলছি, কমিউনিকেট করছি, তাদের নিজেদের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। তারাও বৈজ্ঞানিকভাবে সচেতন হবে, পরে বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে নিতে পারবে। এবং, তাদের অনেক সন্দেহও দূর হবে।

চিরশ্রী: ২৮ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে বাচ্চাদের সঙ্গে একটা ইভেন্ট আছে। সেখানে আমরা মূলত এই বিষয়টা নিয়ে বলতে চাই যে, আমরা বাচ্চাদেরকেও কোনোভাবে নিযুক্ত করতে চাইছি ‘এলেবেলে’-র সঙ্গে। কারণ, শুরুটা আমরা করলাম, আমরাই শুধু লিখলাম, সেরকম তো না। বাচ্চাদেরকে আমরা যদি জিনিসটা না দিয়ে যেতে পারি, তাহলে তো ব্যাপারটার কোনও মানে থাকে না। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার নেশার ভূতটা তো তাদের মধ্যেও ঢোকাতে হবে। সেটার একটা চেষ্টা করব বলে আমরা ভেবেছি। দেখা যাক, সেটা কীভাবে এগোয়। বাচ্চাদের জন্য একটা সেগমেন্টও আনার কথা ভাবছি। আর একটা বিষয়, সেটা এখনই না, তবে অদূর ভবিষ্যতে একটা পরিকল্পনা আছে। সেটা হচ্ছে, দিনের শেষে সকলেরই ইচ্ছা করে একটা বইয়ের গন্ধ শুঁকতে। হার্ড কপিতে একটা কিছু থাকবে। সেটা যদিও এখনও পুরোপুরি স্বপ্নের স্তরে। সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার পরিকল্পনা ধারেকাছে নেই, তবে বইমেলা-কেন্দ্রিক একটা স্বপ্ন প্রবলভাবে আছে।

  • জনপ্রিয় বিজ্ঞান বা পপুলার সায়েন্স এবং কল্পবিজ্ঞান, মানে সাহিত্যে বিজ্ঞান-সম্পর্কিত এই দুটো শাখা নিয়ে তোমাদের কোনও পরিকল্পনা আছে?

প্রত্যয়: কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আমরা কোনোভাবেই আগ্রহী নই। আমাদের নিজেদের মধ্যেই এটা নিয়ে বহু আগেই আলোচনা হয়েছিল। কারণ, ওটা সাধারণভাবে বিজ্ঞান নয়। ওটার সঙ্গে একটা গুজবকে আলাদা করে দেখার কোনও মানে হয় না। কল্পবিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে, অনেকে লেখেন, সেসব ঠিক আছে। সেটা আলাদা ব্যাপার। আমিও সাই-ফাই ছবি দেখতে ভালোবাসি। ‘স্টার ট্রেক’ আমার খুবই পছন্দের। ব্যস, ওই পর্যন্তই। সেটার সঙ্গে বিজ্ঞানের সরাসরি কোনও যোগাযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না।

আর দ্বিতীয় কথা যেটা, জনপ্রিয় স্তরে বিজ্ঞান লেখার যে ব্যাপারটা, এক্স্যাক্টলি সেটাই তো আমরা করছি। কিন্তু সেটা লেখার জন্য এই কথাটা বলে নেওয়া খুব জরুরি যে, পপুলার সায়েন্স অনেকেই লিখেছেন অতীতে কিন্তু, সমস্যাটা হচ্ছে, এখানেও কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানটা আর বিজ্ঞান থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে অতি সরলীকরণের কারণে যেটা আসল বিজ্ঞান, তার বদলে একটা অবান্তর কিছু বলে বসলাম। সেটাকে তো আমি আর বিজ্ঞান হিসেবে ধরতে পারব না। সেজন্য পপুলার লেভেলে লিখতে গেলে এটা খুব ভালোভাবে মাথায় রাখা দরকার যে, বিজ্ঞানটা যেন কোনোভাবে বিকৃত না হয়ে যায়।

  • পপুলার করতে গেলে বাজারচালিত করা বা পণ্য করার যে একটা ব্যাপার চলে আসে, হয়তো সেটার কারণে অনেক সময়েই মূল জায়গাটা থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

প্রত্যয়: দ্যাখো, বাজারচালিত করার হাজারটা উপায় আছে। হ্যাঁ, তুমি যেটা বলছ, সেটা ঠিকই। আমাকেও যখন লিখতে হয়, আমি জানি যে, আমাকে এমনভাবে লিখতে হবে যাতে, সাধারণ মানুষ অন্ততপক্ষে একটা প্যারাগ্রাফ পড়ে। একটা প্যারাগ্রাফ পড়ে তার যদি আগ্রহ জন্মায়, তাহলে বাকিটা সে পড়ে নেবে। মানুষের মনোযোগের স্প্যান এখন তিন সেকেন্ডের, তোমাকে ওই তিন সেকেন্ডের মধ্যে তাকে ধরতেই হবে। সেটা ধরতে গেলে অনেক সময়েই আমাদের জিনিসটাকে একটু পেঁচিয়ে, একটু ঘুরিয়ে, একটা অন্য কিছু গল্প বলে করতে হয়। সম্প্রতি আমি ‘জেনো প্যারাডক্স’ বলে একটা বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে আমাকে একটা কাল্পনিক মহাভারতের গল্প লিখতে হয়েছিল, যাতে লোকে ওইটুকু অংশ পড়ে। জেনো প্যারাডক্সটা কী, বা সেটা কেন ভুল, সেটা বলার সময়ে কিন্তু আমি বিজ্ঞানকে এতটুকু বিকৃত করছি না। কিন্তু আমার গল্পটা শুধুমাত্র পণ্য হিসেবে বিক্রি করার জন্য একটু আকর্ষণীয় ভাবে লেখা। ওটা যদি আমি না লিখি, তাহলে, প্রথম এক লাইনে জেনো প্যারাডক্স এটা, পরের একটা লাইনে এটা কেন ভুল, তৃতীয় লাইনে অ্যারিস্টটল এই বললেন, আর্কিমিডিস এই বললেন, তারপরে বার্ট্র্যান্ড রাসেল এই বললেন, ব্যস, চার লাইনে গল্প শেষ। ওই চার লাইন কেউ পড়বে না। ওই পোস্টে একজন এসে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা কি কল্পবিজ্ঞান?’ আমি তাঁকে বলেছিলাম, ‘না, এটা হচ্ছে কল্প বিজ্ঞান।’

‘এলেবেলে’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে ক্লিক করুন এই ওয়েবসাইটে: https://www.elebele.org/

 তথ্য সহযোগিতায় ও ছবি সৌজন্যে: উদ্দালক বিশ্বাস

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!