২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হাতিদের সঙ্গে যাপন তাঁর। জীবন শুরু করেছিলেন পশু চিকিৎসক হিসেবে। ধীরে ধীরে এটাই হয়ে ওঠে তাঁর জীবন। সাধারণ চিকিৎসকের গণ্ডি ছাড়িয়ে মনোনিবেশ করেন হাতির কল্যাণ ও সংরক্ষণে। তবে শুধু হাতিই নয়, হাতির দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, সেই মাহুতদের কল্যাণেও নিয়োজিত করেন নিজেকে। বছরে ৭০০ থেকে ৮০০ হাতির চিকিৎসা করা এখন তাঁর কাছে নিয়মিত হয়ে গেছে। দীর্ঘ কর্মজীবনে শতাধিক উগ্র হাতিকে সফলভাবে শান্ত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁকে চোখের সামনে দেখতে হয়েছে প্রিয়জনের মৃত্যুও। তাও দমে যাননি ‘হাতির ডাক্তারবাবু’। হ্যাঁ, এই নামেই গোটা দেশে পরিচিত তিনি। পোশাকি নাম ডঃ কুশল কোঁয়র শর্মা। অসমের মানুষ। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে পেয়েছেন ভারত সরকার-প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী সম্মান’। ২০১৮ সালে তাঁকে দেওয়া হয়েছে ‘এলিফ্যান্ট ম্যান অফ এশিয়া’ খেতাব। কিন্তু প্রাণ-দরদী চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কাছে বড় পুরস্কার হয়ে ওঠে সুস্থ হওয়ার পর বিশালাকার জীবগুলি যখন নির্মোহ ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায় তাদের পরম মানব-বন্ধুর দিকে। ‘ভিন্নসময়’এর প্রতিনিধি সোহম দাস-এর সঙ্গে নিজের জীবন, কর্মদর্শন, হাতি ও হাতি-সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে অন্তরঙ্গ আড্ডা দিলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। আজ রইল প্রথম কিস্তি।

 

  • পশু চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পিছনে আপনার মধ্যে কী ভাবনা কাজ করেছিল?

আমি আসলে গ্রামের ছেলে। যদিও পেশার কারণে আমাকে শহরেই থাকতে হয়, তবু মনটা ভীষণ ভাবেই গ্রামের রয়ে গেছে। আমি বড় হয়ে উঠেছি চারপাশে নানা ধরনের পশুপাখি দেখতে দেখতেই। আমাদের ছিল বিরাট যৌথ পরিবার। সেই বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস, পায়রা এমন নানা ধরনের পোষ্য ছিল। আর অদ্ভুতভাবে, আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে একটা হাতিও ছিল। সেটা ছিল মেয়ে হাতি, নাম লক্ষ্মী। ঠিক পোষ্য নয় অবশ্য। তার মালিক ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, তিনি ওই লক্ষ্মীকে কাঠ বহনের কাজে ব্যবহার করতেন, ভূটান পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায়। যেসময়টায় জঙ্গলে কোনও কাজ থাকত না, হাতিটা তখন আমাদের কাছেই থাকত। কারণ, আমাদের একটা বিশাল বাগান ছিল।

সেই বাগানের মধ্যে দিয়ে একটা নদী বয়ে যেত, সেখানে হাতির চরে বেড়ানোর মতো ফাঁকা মাঠ ছিল, অনেক ধরনের সবজির ক্ষেত ছিল, বাঁশঝাড় ছিল, কলাবাগান ছিল। সেজন্য বছরের ওই তিন মাস যখন লে-অফ পিরিয়ড চলত, তখন লক্ষ্মী আমাদের সঙ্গেই সময় কাটাত। আমার তখন হয়তো ছ’বছর বয়স। আমার এখনও মনে আছে, আমার সঙ্গে লক্ষ্মীর একটা সুদৃঢ় অন্তরের বন্ধন ছিল। তার যে মাহুত ছিল, সে ছিল মদ্যপ এবং আফিমখোর। মাহুতদের এটা একটা সাধারণ নেশা। সে যখন লক্ষ্মীকে নদীতে চান করাত, তখন আমার তুতো ভাইবোনেরাও আশেপাশে থাকত, কিন্তু আমার সঙ্গে লক্ষ্মীর একটা আলাদাই সম্পর্ক ছিল। অনেক সময়েই তার পিঠে চড়ে নদী পারাপার করেছি, কখনও কখনও তাকে ঘুরতেও নিয়ে যেতাম।

আরও পড়ুন
ভিন্নসময় এক্সক্লুসিভ: ‘২৬ জানুয়ারি যা ঘটেছে তা পুরোপুরি ষড়যন্ত্র ছিল’– কৃষক নেতা রামিন্দর সিং পাটিয়ালা

সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।
হাতিবন্ধু ডাক্তার কুশল কোঁয়র শর্মা

সেই সময়েই বাবা বদলি হলেন। উনি সরকারি দপ্তরে ফার্মাসিস্ট ছিলেন, এছাড়া আমাদের নিজস্ব ফার্মাসিও ছিল। বাবার বদলি হওয়ার ফলে আমাদেরকেও তাঁর সঙ্গে যেতে হল, আমাদের গ্রাম থেকে মোটামুটি ১২ কিলোমিটার দূরে, একটু উত্তরের দিকে। আমি সেখানকার স্কুলেই পড়াশোনা করেছি। তারপর আমরা যখন ফিরে আসি, লক্ষ্মী তখন আর নেই। আমার ঠাকুমা আমায় জানালেন, কোনও এক সংক্রামক রোগের শিকার হয়ে সে মারা গেছে। সেই কিশোর বয়সে এই মৃত্যুর খবরটা আমাকে ভীষণরকমের একটা মানসিক ধাক্কা দেয়। আমি রীতিমতো কাঁদতে শুরু করি। নালিশের সুরে ঠাকুমাকে বলি, তোমরা কেন তাকে চিকিৎসা করালে না? ঠাকুমার আমায় উত্তর দেন, মানুষের জন্যই ডাক্তার নেই, হাতির জন্য ডাক্তার তুমি কোথায় পাবে? এটা শুনে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, লক্ষ্মী বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেছে। এই মানসিক আঘাতটা দীর্ঘদিন আমার মনে থেকে গিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে আমি ভুলে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু অবচেতন মনে রয়ে গিয়েছিল।

তারপর আমি গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে প্রি-ইউনিভার্সিটি মানে ১০+২ স্তরের পড়াশোনা শেষ করি। আমার দারুণ রেজাল্ট হয়েছিল। আমি মেডি্কেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ফার্মাসি কলেজ, এমন নানা কলেজের ভর্তির তালিকায় আমার নাম ওঠে। কিন্তু কোনও অদ্ভুত কারণে, খানিকটা আবেগের বশেই, আমি আমার বাবাকে বলি, আমি ভেটেরিনারি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। বাবা বেশ অবাক হয়ে যান। তিনি চেয়েছিলেন, আমি একজন মেডিকেল ডাক্তারই হই যেহেতু তিনিও চিকিৎসা ক্ষেত্রে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু আমি বলি, না, আমি ভেটেরিনারি সায়েন্স নিয়েই পড়ব। এর পিছনে অবশ্য একটা ব্যবহারিক কারণও ছিল, যার জোরে আমি বাবাকে রাজি করাতে পেরেছিলাম। সেটা হল, সেই সময়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে কাজের সংকট দেখা দেয়। কিন্তু ভেটেরিনারি পাস করলে চাকরি ছিল বাঁধা। আর কোর্সটাও ছিল মাত্র পাঁচ বছরের, কিন্তু মেডিক্যালের ক্ষেত্রে সেটা সাত বছর লেগে যেত, ইন্টার্নশিপ ইত্যাদি নিয়ে। আর আমার পরিবারেরও অবস্থা তখন খুব ভালো নয়। আমার একটা রোজগারের খুব দরকার ছিল, যাতে আমার ভাইবোনেদের পাশে আমি দাঁড়াতে পারি। দায়িত্বগ্রহণের একটা ব্যাপার ছিল। অর্থাৎ, আমার এই ভেটেরিনারি পড়ার ক্ষেত্রে দুটো সম্মিলিত বিষয় কাজ করেছিল – পশুপাখির প্রতি আমার ভালোবাসা এবং পরিবারের দায়িত্বগ্রহণ।

আরও পড়ুন
প্রজাতন্ত্র দিবস স্পেশাল: কৃষকরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, যদি লড়তেই হয় তবে একজোট হয়ে লড়াই ভালো

সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।
চলছে শুশ্রুষা, হাতির অপারেশন করছেন ডাক্তারবাবু

  • পরবর্তীকালে আপনি হাতিদের চিকিৎসায় যে নিজেকে নিয়োজিত করলেন, সেই অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে?

স্নাতক স্তরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ মার্কস পেয়েছিলাম, সঙ্গে সোনার মেডেলও। মজার ব্যাপারও একটা ঘটেছিল। আমাকে সরকারি পদে নিয়োগ করা হয়েছিল কলেজের তরফ থেকেই, যদিও আমি নিজে থেকে সেই কাজের জন্য কোনও আবেদনই করিনি। শুনেছিলাম, সেই কাজের বেতন ছিল মাসে প্রায় সতেরো হাজার টাকা। তখন আমার কলেজের এক অগ্রজ আমাকে বলেন, তুমি সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র, তোমার এখানেই থেকে গবেষণার পথে যাওয়া উচিত। তুমি কোনও একটা ক্লিনিক্যাল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করো, পরে তুমি প্র্যাক্টিস থেকেও ভালো উপার্জন করতে পারবে, তোমার ডিগ্রিও হবে। ভাগ্যক্রমে, আমি যে বিভাগে যোগদান করলাম, সেটা সার্জারি বিভাগেই। সেই বিভাগের প্রধান যিনি ছিলেন, তিনিই ছিলেন আমার অন্যতম গাইড। তাঁর নাম ছিল ডঃ সুভাষচন্দ্র পাঠক। হস্তি চিকিৎসায় তিনি ছিলেন তখনকার একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। বলতে গেলে, ডঃ পাঠকের সঙ্গে কাজ করতে করতেই আমি হাতিদের চিকিৎসায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল ‘এলিফ্যান্ট অ্যানাস্থেশিয়া’।

খুব কম সময়ের মধ্যেই, এই মোটামুটি দু-তিন বছরের মধ্যেই আমার নামটা বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে। আমার হয়তো কোনও ভালো গুণ ছিল, আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, মানুষ আমায় ভালোবাসতেন। আমি তাঁদের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যেতে পারতাম, হাতিদের সঙ্গে খুব সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারতাম। আমার কাজের জন্য আমি বেশি পারিশ্রমিকও চাইতাম না। হাতিদের চিকিৎসা করার কাজটাই আমার কাছে খুব তৃপ্তিদায়ক হয়ে উঠেছিল। প্রচুর টাকা উপার্জন করতে হবে, এটা কখনোই আমার মূল লক্ষ্য ছিল না। হাতিদের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগত, এটাই ছিল আমার অনুপ্রেরণা। এই হল আমার সাঁইত্রিশ বছরের চিকিৎসক-জীবন। প্রতিদিন রাতে হাতিরাই আমার স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। এখনও অবধি আমি ১৩টা বই লিখেছি হাতিদের নিয়ে, যার মধ্যে রোগ (Rogue) হাতি ধরার অভিযানের কাহিনিও আছে, হস্তি-বিজ্ঞান নিয়েও নানা বই আছে, এলিফ্যান্ট ডিজিজ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বই আছে।

আরও পড়ুন
  ‘ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশগুলোর মানুষজন পরস্পর মুখোমুখি হলে আসলে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়’- আকিল কুমারাসামি

সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।
স্বাস্থ্যশিবিরে চলছে হাতির দেখভাল

 

  • পশু চিকিৎসার মৌলিক কাঠামোটি কীরকম?

আপনি যদি সারা বিশ্বের নিরিখে দেখেন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন, পশু চিকিৎসা কিন্তু প্রভূত উন্নতি করেছে। এখনও অবধি ১০৭ কি ১০৮ জন বিজ্ঞানী চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এবং তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই পুরস্কারটি পেয়েছেন পশুদের ওপর কাজ করার জন্য। তাঁরা হয়তো ভেটেরিনারিয়ান নন, কিন্তু পশুদের ওপর কাজ করেই পুরস্কার পেয়েছেন। ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড যেমন প্রথমে কুকুরদের মধ্যে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেছিলেন। সেখানে যখন সফল হলেন, তখন মানুষের ওপর চেষ্টা করলেন। আপনি যদি উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখেন, তাহলে দেখবেন খুব উজ্জ্বল মেধার ছাত্রছাত্রীরাই ভেটেরিনারি পেশায় আসে। এর প্রধান কারণ, উন্নত দেশগুলোতে পশুপাখিদের একটা সামাজিক গুরুত্ব আছে, ফলে এই পেশাকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ভারতে কিন্তু তেমনটা হয় না। যদিও সারাজীবন ধরে এই কাজ করে আসার পর বর্তমানে দেখছি, পশু চিকিৎসার চাকচিক্যের জায়গাটা ক্রমশ বাড়ছে। কারণ হচ্ছে, এদেশে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের সংখ্যা এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে, পোষ্য প্রাণিদেরও একটা গুরুত্ব বাড়ছে। আর পোষ্যদের চিকিৎসার জন্য লোকে খরচার পরোয়া করে না। কিন্তু খামারের প্রাণিদের জন্য সেটা প্রযোজ্য নয়।

ধরা যাক, খামারের একটা পশুর চিকিৎসার জন্য খরচ পড়বে ষাট হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে একজনের জন্য আপনি কতই বা খরচ করতে পারবেন। কিন্তু একটা পোষা কুকুরের জন্য মানুষ অত খরচ নিয়ে ভাববে না, কারণ তারা প্রায় পরিবারেরই অংশ। এভাবেই ভারতেও ধীরে ধীরে পশু চিকিৎসার ক্ষেত্রটি উন্নতি করছে। তবে, বন্যপশুর চিকিৎসায় ভেটেরিনারিয়ানদের যে অবদান, সেটা এখনও ততটা পরিচিতি পায়নি। আমার নিজের কথা যদি বলি, আমার কাজটা কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি দেশের নানা প্রান্ত থেকে ডাক পাই। যেমন, সম্প্রতি আমি বিহারের বাল্মিকী ব্যাঘ্র প্রকল্পে গণ্ডার পুনর্বাসনের কাজ করে এলাম। এছাড়া, অন্যান্য ক্ষেত্রেও কিন্তু পশু চিকিৎসকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আপনি যদি খাদ্য সুরক্ষার কথা ভাবেন, প্রাণিজ খাদ্যের উৎপাদন কিন্তু বন্ধ হয় না। কৃষিজ পণ্যে অনেক সময়ে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু প্রাণিজ খাদ্য, সে পোল্ট্রি হোক কি শূকর হোক কি খাসি হোক, সেখানে কিন্তু উৎপাদন বন্ধ নেই। দুগ্ধ উৎপাদনে সারা বিশ্বে ভারত তো সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে। এছাড়া, ডিম উৎপাদনেও আমরা খুব ভালো জায়গায় আছি। অতএব, ভেটেরিনারি পেশার উন্নতি ভারতেও বর্তমানে হচ্ছে। তবে, খুব সৎভাবে বলতে গেলে, সেই সম্মানের জায়গাটা আমাদের এখনও নেই।

আরও পড়ুন
গান শোনার অভ্যাস থেকেই আমি ভাবলাম, সঙ্গীতকে আমি যদি ছবিতে আনতে পারি- সমীর আচার্য

সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।
উদ্ধার হওয়া একটি বন্য হস্তীশাবকের সঙ্গে হাতিবন্ধু ডাক্তারবাবু

একটি ঘটনার কথা বলতে পারি। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়াই। একটি নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি, অন্যটি নিউ মেক্সিকো স্টেট ইউনিভার্সিটি। নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বন্ধু আছেন, নাম লিসা মিলস। গতবছর তাঁদের পোষ্য কুকুরটির খাদ্যনালিতে একটি মাংসের হাড় আটকে গিয়েছিল। তাঁরা কুকুরটিকে ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিয়ে যান সার্জারির জন্য। সেখানে তারা বলে, অপারেশনের জন্য কুড়ি হাজার মার্কিন ডলার খরচ পড়বে। লিসাদের পক্ষে কুড়ি হাজার মার্কিন ডলার খরচ করার সামর্থ্য ছিল না। উপায় না দেখে তাঁরা ঠিক করেন, কুকুরটির মার্সি কিলিং করাবেন। কিন্তু, আমি শেষ পর্যন্ত অপারেশনটা করি, এবং তা মাত্র দু’হাজার টাকায়, এখানে আমার হাসপাতালে।

ভাবুন, আমেরিকায় কুড়ি হাজার ডলার আর এখানে দু’হাজার টাকা (হাসি)। আপনাদের কলকাতাতেও এভাবেই অল্প খরচে অপারেশন করেন ডাক্তাররা। তাঁরা সকলে আমারই বন্ধুজন। অবশ্যই, আমাদের দেশে পশু চিকিৎসায় পরিকাঠামোগত সুবিধা সেভাবে নেই। ঠিকমতো যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম নেই। আমার যতদূর ধারণা, গোটা ভারতবর্ষে মাত্র একটি ভেটেরিনারি কলেজই আছে, যেখানে এমআরআই স্ক্যানের সুবিধে আছে। আমাদের এখানে নেই। অনেক সময়েই আমাদের সাধারণ কিছু পরিষেবার জন্যেও লড়াই করতে হয়। আলট্রাসাউন্ড মেশিন, কালার ডপলার মেশিন, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফি এগুলো পাওয়া যায় না। কিন্তু এগুলো আমাদের ব্যবহার করতে হবেই। ছাত্রদের ট্রেনিং দিতে হবে। কিন্তু আমাদের এই অসুস্থ রাজনৈতিক সিস্টেম এবং ইউনিভার্সিটি সিস্টেম সেটা হতে দিচ্ছে না। এই পেশাটার উন্নতি দরকার। কারণ, এতে আখেরে মানুষেরই উপকার হবে।

আরও পড়ুন
জাতপাতকে এত স্বাভাবিক ঘটনা বলে আমাদের শেখানো হয়েছে যে, আমরা সেভাবে এটা নিয়ে কথা বলিনি

সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।
মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অসমের রাজ্যপাল প্রফেসর জগদীশ মুখির হাত থেকে ‘এলিফ্যান্ট ম্যান অফ এশিয়া’ খেতাব নিচ্ছেন ডঃ শর্মা

 

  • প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে হাতির একটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। হাতিদের নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা লোককথা, কিংবদন্তি। আমরা দেখেছি, একটি হাতি একজন মানুষের কত বড় বন্ধু হতে পারে। হাতির সঙ্গে মানুষের এই যে হৃদ্যতার সম্পর্ক, এই ধরনের মানসিকতা কি হাতির চিকিৎসায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়। আপনি একদম ঠিক কথাই বলেছেন। হাতিকে কেন্দ্র করে বরাবরই এদেশে একটি ঐতিহ্য রয়েছে। তাত্ত্বিক দিক থেকেও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বেশিরভাগ হিন্দুই মনে করেন, হাতি আসলে গনেশেরই অবতার। রাস্তা দিয়ে হাতি হেঁটে গেলেই মানুষ ‘গনেশবাবা, গনেশবাবা’ বলে প্রার্থনা করে। বৌদ্ধ ধর্মমত অনুসারে, রানি মায়া (সিদ্ধার্থ গৌতমের মা) স্বপ্নে দেখেছিলেন, একটি সাদা হাতি তাঁর শরীরে প্রবেশ করছে। প্রচলিত মত অনুসারে, এই ঘটনা নির্দেশ করে, মোক্ষলাভের আগে বুদ্ধদেব শতবার জন্ম নিয়েছিলেন। বৌদ্ধমতেও হাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আছে। আমাদের দেশে যখন রাজারা ছিলেন, তখন যুদ্ধ, শান্তিস্থাপন, বা রাজকীয় জাঁকজমক প্রদর্শন, সবকিছুতেই হাতিদের ব্যবহার করা হত। তারপরে যখন ব্রিটিশরা এল, হাতিরা তাদের হাতে পড়ে হয়ে উঠল ভারবাহী পশু। এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের সময়ে সেগুলোকে বহনের কাজে হাতির ব্যবহার শুরু হল। ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও সেই অবস্থার আর পরিবর্তন হল না। আমরা ভুলে গেলাম আমাদের সনাতনী সংস্কৃতিতে হাতিদের অবস্থান। যাইহোক, এখনও হাতিদের প্রতি সেই সম্ভ্রমের জায়গাটুকু কিছুটা হলেও আছে।

চিকিৎসক হিসেবে আমি আপনাকে বলতে পারি, আমি সবসময়ে চেষ্টা করি হাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলার। বহু অভিজ্ঞতার গল্প আছে আমার ঝুলিতে, কিন্তু একটা সাক্ষাৎকারে সেগুলো তো বলা সম্ভব নয়। হাতিদের অনুভূতি এবং বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় আমি পেয়েছি এই দীর্ঘ কর্মজীবনে, সেখান থেকে দুটো গল্প আমি বলতে চাই। একটি গল্প এক বন্য হাতিকে নিয়ে, অন্যটি এক বন্দি হাতির গল্প। বন্য হাতিটি উত্তর অসমের পানেরি চা বাগানে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়েছিল। সেটা ছিল একটা কমবয়সী দাঁতাল, সতেরো-আঠেরো বছর বয়স হবে। সকলে ভেবেছিল সে বুঝি মারাই যাবে। আমি সেখানে যাই এবং তাকে প্রায় দু-তিন ঘণ্টা ধরে চিকিৎসা করি। তাকে ইন্ট্রোভেনাস ফ্লুইড দিই, প্রচুর ওষুধ দিই। আর সমানে তার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিলাম। আপনি ভাবতে পারবেন না, ওই দু-তিন ঘণ্টায় সে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল। চিকিৎসা হয়ে গেলে আমি একটা জেসিবি আর্থমুভারের সাহায্যে হাতিটাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করি। আমি ছিলাম ওই জেসিবির কেবিনের মধ্যে। হাতিটা উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। সামনের জঙ্গলেই ছিল ওর দলের অন্যান্য সদস্যরা, তারা ওকে ডাকছিল। জঙ্গলে দলের কাছে ফিরে যাওয়ার আগে সে একঝলক আমার দিকে তাকায়। সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না। আমি বুঝেছিলাম, সে আমায় ধন্যবাদ জানিয়ে গেল। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন এই ঘটনাটা আমার মনে থেকে যাবে।

আরও পড়ুন
‘’৮৩ সালে যে ভারতবর্ষকে দেখেছিলাম, তারপর থেকে ভারতবর্ষ অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে

সেদিন তার চোখে যে ভাষা দেখেছিলাম, একজন ডাক্তারের কাছে তার চেয়ে বড় পারিশ্রমিক আর কিছু হতে পারে না।
হাতির জন্য বিশেষ ধরনের মেডিকেশন শ্যু

অন্য ঘটনাটির কথা বলি এবার। আমি তখন সেন্ট্রাল জু অথরিটির সার্কাস এলিফ্যান্ট ইভ্যালুয়েশন কমিটির সদস্য। আমি আর সুপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায় গিয়েছিলাম গুজরাটের হিম্মতনগরে। ওখানে একটা সার্কাসে ছ’টা হাতি ছিল। একটা হাতিকে পরীক্ষা করার সময়ে আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করি। সার্কাসের লোকজন বলে, ওর নাম লক্ষ্মী। যাইহোক, আমি আমার কাজ করে যাচ্ছিলাম, হঠাৎই আমাকে অসমের এক বন্ধু ফোন করেন। তিনি ডব্লিউডব্লিউএফের (WWF, World Wide Fund for Nature, আগে নাম ছিল World Wildlife Fund) সদস্য ছিলেন।

একটি কুনকি হাতি আহত হয়েছিল, তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তিনি আমায় ফোন করেন। আমি সেইমতো নির্দেশ দিতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে ওই হাতিটা (লক্ষ্মী) তার শুঁড় দিয়ে খুব ধীরে ধীরে আমাকে জড়িয়ে ধরতে থাকে। তার মুখটা আমার কাছে চলে আসে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসছে। সার্কাসের লোকজন ভাবে, হাতিটা হয়তো আমায় আক্রমণ করতে চাইছে। তারা ছুটে এসে ‘হেই, হেই’ করে চেঁচাতে থাকে। কিন্তু তার স্পর্শেই আমি বুঝেছিলাম, সে আমার কোনও ক্ষতি করবে না। তারপর আমি যখন তার কাগজপত্র দেখছি, তখন দেখি, তার নাম আসলে ‘লক্ষ্মীমাঈ’। সে অসমেরই হাতি। বারো বছর আগে তার পশ্চাদ্দেশে আমি একটি বড় ফোঁড়া অপারেশন করেছিলাম। সে সেরে উঠেছিল, তারপর তার মালিক সার্কাসের কাছে তাকে বেচে দেয়। সে আমাকে মনে রেখেছিল, এবং বারো বছর পরেও সে আমাকে চিনতে পেরেছে। এটা আমার কাছে অভাবনীয় এক উপহার ছিল।

                                                                                            (পরবর্তী পর্ব আগামীকাল)

সমস্ত ছবি সৌজন্যে: ডঃ কুশল কোঁয়র শর্মা   

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
19FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!