২৫ এপ্রিল, ২০২৪বৃহস্পতিবার

২৫ এপ্রিল, ২০২৪বৃহস্পতিবার

করোনা আবহেও অভিনব নাট্য সন্ধ্যার আয়োজন চুঁচুড়ার নাট্যদল সারথির

গত কয়েকমাস ধরে এক অস্থির সময়ের সাক্ষী আমরা সবাই। এই অস্থিরতার মধ্যে প্রয়োজন অফুরান প্রাণশক্তির। তাই শুধুমাত্র  পেটের তাগিদেই বাঁচা যাঁদের কাছে মুখ্য উদ্দেশ্য নয়,বিশেষ করে যাঁরা সংস্কৃতিবান মানুষ, সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচেন তাঁরা কি করবেন! পেটের  সঙ্গে সঙ্গে মনের খোরাকটাও যে প্রয়োজন। কিন্তু  বিনোদন তথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সমস্ত দরজা এখন প্রায় বন্ধ।  সিনেমা হল, থিয়েটার প্রাঙ্গণে তালা ঝুলছে। কিন্তু থিয়েটার কখনো থেমে থাকেনি বা থেমে থাকতে পারেনা। হাজার হাজার বছরের থিয়েটারের ইতিহাসে অনেক বিপর্যয় এসেছে। কিন্তু থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়নি কখনও। তাই বর্তমান এই করোনা পরিস্থিতিতে নাট্যপ্রেমী মানুষদের মানসিক যন্ত্রণার কথা অনুভব করে চুঁচুড়ার নাট্যদল ‘সারথি’ তাঁদের দলের ৩৬ তম বর্ষপূর্তিতে  চন্দননগরের নাট্যসংস্থা ‘ক্ল্যাসিক’-কে সঙ্গে নিয়ে গত ৪  অক্টোবর একটি ঘরোয়া নাট্যসন্ধ্যার আয়োজন করে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনেই।

 

এবার প্রশ্ন কোন জায়গায় নাটক মঞ্চস্থ করা হবে! নাটকের মঞ্চ হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিলেন চুঁচুড়ার ষণ্ডেশ্বরতলায় সুপ্রাচীন এবং বিখ্যাত পালবাড়ির ঠাকুরদালানটিকে। এই পালবাড়িরও নাটক থিয়েটারের একটা গৌরবময় ইতিহাস আছে। এই বাড়িরই নাটমন্দিরে গৃহদেবতা মদনগোপাল জিউ-র সামনে বাংলা নাটক মঞ্চস্থ হতো এক সময়। আর দর্শকাসনে থাকতেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, মনীষী ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কবির লড়াই হতো এন্টনি ফিরিঙ্গী ও ভোলা ময়রা’র মধ্যে। এছাড়াও কীর্ত্তন, কথকতা, যাত্রা এসবও ছিল।

 

এহেন ঐতিহ্যমণ্ডিত জায়গাকে নির্বাচন করা নিঃসন্দেহেই এক অভিনব উদ্যোগ। ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি নেই। কারণ সারথি’র কর্ণধার শ্রী সমীর সেনগুপ্ত মহাশয় অন্তত তিনমাস আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা ৪ অক্টোবর নাটক মঞ্চস্থ করবেন। গেটে ঢোকার মুখেই স্যানিটাইজার, মিনারেল ওয়াটার,সাইকেল-স্কুটার রাখার ব্যবস্থাও ছিল তাই যথাযথ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আসনসংখ্যা রাখা হয় মাত্র পঞ্চাশটি। কিন্তু আরও কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে  ছিলেন নাটক দেখার জন্য। তাঁদের দেখে সত্যিই অভিভূত হতে হয়। সকলেই নাটক দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। তাই করোনার ভয়কে তুচ্ছ করেই এগিয়ে এসেছেন একটু প্রাণভরে নাটক উপভোগ করে দমবন্ধ পরিবেশ থেকে, হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে।

 

 

এদিন মোট দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রথমটি চুঁচুড়ার ‘সারথি’ নিবেদিত নাটক ‘প্রস্তাব’। আন্তন চেকভের কাহিনীটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্দেশনা সমীর সেনগুপ্ত। দ্বিতীয়টি চন্দননগর ক্ল্যাসিকের প্রযোজনায় চিন্তা মুখার্জি নির্দেশিত নাটক ‘আমাকে মারুন’। বিপুল মজুমদারের গল্প অনুসারে নাটককার হলেন শঙ্কর বসু ঠাকুর।

 

‘আমাকে মারুন’ এর একটি দৃশ্য, ছবি: অর্ণব নন্দী।

 

এদিন অনুষ্ঠানের শুরু হয় সমীর বাবুর কিছু কথা দিয়ে।  এই অনুষ্ঠানটি মূলতঃ ‘সারথি’র দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের সভাপতি তথা সঙ্গীতশিল্পী স্বর্গীয় শ্রী দিলীপ রায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়।  নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং সুধীন দাশগুপ্তর ছাত্র দিলীপবাবু বহু নাটকে সুর দিয়েছিলেন। বিশেষতঃ লোকসঙ্গীত নিয়েই তিনি বহু কাজ করেছিলেন। তাঁরই সুরে সেইরকমই দুটি নাটকের গান এদিনের অনুষ্ঠানের শুরুতে পরিবেশিত হয়। একটি ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ এবং অন্যটি ‘তরাই’য়ের ঘুম ভাঙছে’। শ্রীমতি মোহনা গঙ্গোপাধ্যায়ের কণ্ঠ এবং শ্রী সংকেত গঙ্গোপাধ্যায়ের হারমোনিয়াম সংগতে অত্যন্ত শ্রুতিমধুর সেই গান শ্রোতাদের আপ্লুত করে দেয়।

 

 

এদিনের অভিনীত ‘প্রস্তাব’ আদ্যপান্ত হাস্যরসাত্মক একটি নাটক। চরিত্র তিনটি। প্রাণগোপাল প্রিয়তোষবাবুর কাছে আসেন তাঁর মেয়ে রমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্তাবটি রাখতে গিয়ে ভয় পেয়ে তিনি যেসব অঙ্গভঙ্গী করেন তা সত্যিই বেশ মজাদার। প্রাণগোপাল প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যান এটা দেখে যে প্রিয়তোষবাবু সহজেই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। তারপর সে তো বেজায় খুশি। প্রিয়তোষবাবু বাড়ির ভেতরে চলে যান মেয়েকে ডাকতে। তারপর মেয়ের সঙ্গে চলে প্রাণগোপালের প্রাথমিক আলাপচারিতা ও কথোপকথন। শুরুতে তা ছিল মিষ্টি মধুর লাজুক লাজুক। পরমুহূর্তেই তা আস্তে আস্তে পারিবারিক জমিজমার দখল সংক্রান্ত কলহে পরিণত হয়।… বাবুও এসে যোগ দেন সেই কলহে। বাবা, মেয়ে দু’জনের কেউই প্রাণগোপালকে ছেড়ে কথা বলেন না। তারপর প্রিয়তোষবাবু গালিগালাজ করে প্রাণগোপালকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। মেয়ে তখনও ওই ‘প্রস্তাব’ সম্পর্কে কিছুই জানতোনা। পরে বাবার কাছে শুনে প্রাণগোপালকে ফিরিয়ে আনতে অনুরোধ করে। পাত্র ফিরে আসে এবং হয়ে যায় মধুরেণসমাপয়েৎ। তবে সানাই বাজার সাথে সাথে    মিষ্টি মধুর কলহ চলতেই থাকে।

 

 

প্রস্তাব নাটকের একটি দৃশ্য, ছবি: অর্ণব নন্দী

 

 চরিত্রায়ণে  প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ অভিনয় করেছেন। রাগী, কলহপ্রিয় বৃদ্ধের ভূমিকায় অমিতাভ সেন অনবদ্য। প্রাণগোপালের চরিত্রের কৌতুকাভিনয়ও সায়ন্তন ঘোষ দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন। আর মেয়ের ভূমিকায় ত্রয়ী বিশ্বাস অসাধারণ! যেমনই স্পষ্ট তার স্বরক্ষেপণ এবং বাচনভঙ্গি তেমনই তার নিখুঁত শারীরিক অভিব্যক্তি। সত্যিই প্রশংসনীয়। নির্দেশক সমীর সেনগুপ্ত অত্যন্ত সুচারুভাবে এই তিন চরিত্রকে মঞ্চে এনেছেন শুধু নয় বরং সেই সঙ্গে বর্তমান এই করোনার পরিস্থিতিকেও নাটকে প্রয়োগ করেছেন।

 

 

এবার নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় নাটক  ‘আমাকে মারুন’ । হরসুন্দরী বিদ্যামন্দির স্কুলের এস.এম. স্যারের বাড়িতে হেড স্যার এসেছেন তাঁকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে। স্যার তো নিজের সিদ্ধান্তে অটল যে তিনি আর কিছুতেই স্কুলে ফিরবেন না। হেড স্যার চলে যাওয়ার পরমুহূর্তেই বলাই নামে একজন লোক ঘরের ভেতর ঢুকলো। এরপরের কথোপকথন (এস.এম.স্যার এবং বলাই’র মধ্যে) ও ঘটনাবলী বেশ চাঞ্চল্যকর। ওই বলাই লোকটা আগে ছিল চোর এবং পকেটমার। পরবর্তীকালে তার নাকি আর ওইসব করতে ভালো না লাগায় সে একেবারে অন্য উপায় খোঁজে। সে স্ব-ইচ্ছায় লোকেদের কাছে মার খায় এবং তার বিনিময়ে টাকা নেয়। লোকজন তাদের টেনশন থেকে মুক্তি পেতে তার শরীরে আঘাত করে। তবে অবশ্য যেখানে-সেখানে নয়, মার খাওয়ার জন্য বলাই বেছে নিয়েছে তার পিঠকে। আর দেহে মার খাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলাই বলে যে পেটে যেন লাথি মারবেন না। কারণ এই পেটের দায়েই তো এ কাজে নামা!  যাইহোক এই বলাই-ই কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় ‘আমাকে মারুন’ বলে আর সেই দেখেই এস.এম.স্যার তাকে ফোন করে ডেকে পাঠায়। তবে স্যারের মারার ইচ্ছে শুনে বলাই বেশ কিছুটা হতবাক হয়। কারণ স্যার তাকে বেত দিয়ে মারবেন। জিনিসটা তার কাছে বেশ অভিনব লাগে। এই নাটকের অন্তর্নিহিত গূঢ় মর্মার্থ নিঃসন্দেহে সমাজের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে আনে।

 

 

এই বেত মারার পরিতৃপ্তি থেকে অনুতপ্ত হওয়ার অভিব্যক্তির যে রূপান্তর সেটা অসম্ভব ভালো ফুটিয়ে তুলেছেন এস.এম.স্যার অর্থাৎ শ্রী তুষার ভট্টাচার্য্য মহাশয়। হেড স্যারের ভূমিকায় কাজল চক্রবর্তী দারুণ অভিনয় করেছেন। কখনও কৌতুকী আবার কখনো বা সিরিয়াস। আর বলাই ওরফে চিন্তা মুখার্জির  তুলনা তো তিনি নিজেই। চিন্তাবাবুই এই নাটকের পরিচালক। স্বল্প মঞ্চসজ্জা, সুপ্রযুক্ত আলো এই নাটকে অন্য মাত্রা এনে দেয়। প্রসঙ্গতঃ দুটি নাটকের আলোক পরিকল্পনা করেছেন মাঃ বাপী। অভিনয়ের পাশাপাশি, নাট্য পরিচালনাতেও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন চিন্তাবাবু।

 

আমাকে মারুন নাটকের একটি দৃশ্যে তুষার ভট্টাচার্য, ছবি: অর্ণব নন্দী

 

চুঁচূড়ার ‘সারথি’র এই প্রয়াস খুব সম্ভবতঃ হুগলী জেলায় এই প্রথম। আর তাঁরা এতোটাই সফল যে দর্শকদের বিশেষ করে সেদিন যাঁরা নাটক দেখতে পাননি তাঁদের অনুরোধে এই দুটি নাটক আবারও মঞ্চস্থ হতে চলেছে আগামী ১৮ ই অক্টোবর ওই একই নাটমন্দিরে।

 

নাট্য আলোচনা: শাশ্বতী দাস

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!