২৫ এপ্রিল, ২০২৪বৃহস্পতিবার

২৫ এপ্রিল, ২০২৪বৃহস্পতিবার

দ্য কাটার ইনসিডেন্ট: পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারক পেতে পারতেন নোবেল, কিন্তু হতে হয়েছিল বদনামের ভাগী

ভ‍্যাকসিন, বর্তমান করোনা আবহে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি শব্দ। করোনা ভ‍্যাকসিন আবিষ্কারের পথ চেয়ে বসে আছেন বিশ্ববাসী। তবে ভ‍্যাকসিন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই তা শরীরে প্রবেশ করালে কোন বিপদের আশঙ্কা নেই তো? সেক্ষেত্রে কিন্তু ভ‍্যাকসিন আবিষ্কার আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ বয়ে আনতে পারে, যেমনটি হয়েছিল আমেরিকায় পোলিও ভ‍্যাকসিন আবিষ্কারের সময়ে যা কাটার ইনসিডেন্ট বা কাটার দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত।

১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি পশ্চিম ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে ২০০,০০০-এরও বেশি শিশুকে একটি পোলিও ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল যাতে পরীক্ষামূলকভাবে, এবং এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার প্রক্রিয়াটি ত্রুটিযুক্ত বলে প্রমাণিতও হয়েছিল। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ‍্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে প‍্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতের খবর আসতে শুরু করে।

আরও পড়ুন
দ্য থার্ড ডিফেনেস্ট্রেশন- যে ঘটনায় ৩০ বছর ব্যাপী ভয়ঙ্কর যুদ্ধে মারা যায় ইউরোপের প্রায় অর্ধেক পুরুষ

১৯৫৩ সালের মহামারীর সময় লোহার কেবিনেটে রাখা পোলিও রোগী

এই ঘটনার একমাসের মধ‍্যেই পোলিও প্রতিরোধের জন্য গণটিকাকরণ কর্মসূচী বন্ধ করে দিতে বাধ‍্য হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য দপ্তর। এই ঘটনার তদন্তে উঠে আসে ক‍্যালিফোর্নিয়ার একটি পারিবারিক ফার্মের কাটার ল‍্যাবরেটরিতে যে ভ‍্যাকসিনগুলি তৈরী হয়েছিল, সেগুলিই চল্লিশহাজার শিশুর পোলিও রোগ থেকে মুক্তি না পাওয়ার কারণ ছিল এবং প্রায় দুশোরও বেশি শিশু  এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে বরাবরের জন‍্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং দশজন শিশু মারাও যায়।

পল অফিট, বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং টিকাকরণের আইনজীবী এই কাটার দুর্ঘটনাকে পোলিও ও অন‍্যান‍্য সংক্রমণজনিত রোগের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন‍্যতম সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আমাদের মনে করান যে ১৯০৮ সালে কার্ল ল‍্যান্ডস্টেইনারের পোলিও ভাইরাস আবিষ্কারের দশ বছরের মধ‍্যেই নিউইয়র্কের মহামারীতে প্রায় চব্বিশশো মানুষ মারা যান যাদের মধ‍্যে অধিকাংশই ছিল শিশু। এছাড়াও হাজারেরও বেশি শিশু আজীবন পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছিল।

আরও পড়ুন
মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে এই ধর্ম, ভারতেও রয়েছে মন্দির

১৯৫৫ সালে কাটার ল্যাবোরেটরিতে তৈরি পোলিও ভ্যাকসিনের ভায়াল

এরপর ১৯৫০ সালে গ্রীষ্মকালীন সময় পোলিওর প্রাদুর্ভাবে প্রায় হাজার দশেক পোলিও সংক্রমণের ঘটনা ঘটে যেখানে প্রায় একশো জন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে  অথবা মৃত‍্যুবরণ করে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় পারমাণবিক বোমার পর পোলিওই সেই দ্বিতীয় ভীতি যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবাসীরা সবচেয়ে ভয় পেতেন।

অফিট, আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের পোলিও সম্পর্কিত ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়া ‘মার্চ অফ ডিমস’ ক‍্যাম্পেনের মাধ‍্যমে এবং এই রোগের প্রতি জাতীয় ক্ষেত্রে মনোযোগ আকর্ষণ করার উদ‍্যোগকে প্রশংসনীয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি, তিনি জোনাস সক এবং অ্যালবার্ট সাবিনেরও উল্লেখ করেছেন। এই দুই কিংবদন্তী বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁদের অসামান্য অবদানের পাশাপাশি নিজেদের তিক্ত শত্রুতা ও চারিত্রিক ত্রুটির জন‍্যও স্মরণীয় হয়ে আছেন। বলা বাহুল্য এই শত্রুতার ভিত্তিও ছিল উল্লিখিত পোলিও দুর্ঘটনা।

আরও পড়ুন
শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ধর্মমত রাস্তাফারি শুধু ধর্ম নয় এক সংস্কৃতিও, যা আকৃষ্ট করেছিল বব মার্লেকেও

সেন্ট মেরিজ হাসপাতালে লোহার ক্যাবিনেটে রাখা ২ মাসের শিশু মার্থা অ্যান মেরিকে পর্যবেক্ষণ করছেন নার্স মার্থা স্যামনার (১৯৫২)

অফিট, কাটার দুর্ঘটনা এবং সক ও সাবিনের ভ‍্যাকসিনেশন দুটি ঘটনার একটি তুল‍্যমুল‍্য বিচার করেছেন। প্রস্তুতিতে ব‍্যর্থতা এবং তদন্ত প্রক্রিয়া মাথায় রেখেও তিনি বিজ্ঞানী সক এর দোষ এড়িয়ে তিনি বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার এবং ভ‍্যাকসিন নির্দেশক সংস্থা এই দুর্ঘটনাকে সহজেই এড়াতে পারতো। যে তিনটি কোম্পানি সকের নির্দেশিকা মেনে পোলিওর ভ‍্যাকসিন প্রস্তুত করে তারা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে ফর্মালডিহাইড ব‍্যবহার করে। যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অভাব এবং কাটার ল‍্যাবরেটরির কর্মচারীদের অদক্ষতাই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ।

যে ভ‍্যাকসিন আবিষ্কারের জন‍্য জোনাস সক পেতে পারতেন নোবেল পুরষ্কার তা থেকেও বঞ্চিত করা হয় তাঁকে এবং অফিটের মতে এর পিছনেও মদত ছিল সহকর্মী তথা প্রতিযোগী বিজ্ঞানী সাবিনের। সাবিন পোলিও টিকাকরণের যে ব‍্যবস্থা করেন, অফিটের মতে তাও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ব‍্যবস্থা নয়। যদিও আমেরিকা তথা বিশ্ববাসীর কাছে আজও জোনাস সক কাটার দুর্ঘটনার প্রধান ভিলেন রূপে চিহ্নিত হয়ে রয়ে গিয়েছেন।

আরও পড়ুন
রহস্যময় আটলান্টিস : সলিল সমাধিই কি নিরুদ্দেশ শহরের পরিণতি?

নিজের ল্যাবরেটরিতে সহায়ক ইথেল জে বেইলি-এর সঙ্গে কাজ করছেন জোনাস ই সক (১৯৫৪)

সককে ভিলেনরূপে চিহ্নিত করা হলেও পোলিও টিকা আবিষ্কারের পরেই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির অল্প দামে আইন ভেঙে ভ‍্যাকসিন কেনার প্রবণতার জন‍্যই ঘটে যায় এত বড় দুর্ঘটনা। ঠিক সেই কারণেই পল এ অফিট বলছেন বিশ্বজুড়ে ভ‍্যাকসিনের যতই চাহিদা থাক, প্রতিটি ভ‍্যাকসিন তৈরী হওয়া উচিত জলবায়ু, রিস্ক ফ‍্যাক্টর এবং উপযুক্ত ভ‍্যাকসিন আইনকে মাথায় রেখে। নাহলে কে বলতে পারে কাটার দুর্ঘটনার মতো ভবিষ‍্যতেও ভ‍্যাকসিন মানবজাতির কল‍্যাণের বদলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে দেখা দেবে না।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!