২৬ এপ্রিল, ২০২৪শুক্রবার

২৬ এপ্রিল, ২০২৪শুক্রবার

এক গ্রন্থাগারিক প্রথম পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেছিলেন

আধুনিক সময়ে ভূবিজ্ঞান এতটাই এগিয়ে গিয়েছে যে নিখুঁত হিসেব করে পৃথিবীর পরিধি আয়তন বের করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এমনকি পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত, মঙ্গল গ্রহ থেকে আমাদের এই পৃথিবী কত দূরে অবস্থিত তাও প্রায় নিখুঁত ভাবে বের করে ফেলেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। কিন্তু আজ থেকে ২,২০০ বছর আগে বিষয়টা এতো সহজ ছিল না। সেই সময়ে কেবলমাত্র কম্পাস ও স্কেল আবিস্কার হয়েছিল। কিন্তু টেলিস্কোপ বা অন্যান্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়নি। কম্পাস ও স্কেলের সাহায্যে এক গ্রন্থাগারিক পৃথিবীর পরিধি প্রথম নিখুঁতভাবে পরিমাপ করেন।

খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৭৬ সালে মিশরের ছোট্ট শহর সাইরিনে জন্মগ্রহণ করেন ইরাটোস্থেনেস। সেই সময় গ্রিক বীর আলেকজান্ডার মারা যাওয়ার পর তার বিখ্যাত সেনাপতি টলেমি মিশর শাসন করছেন। তিনি বরাবর জ্ঞানীদের কদর করতেন। রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়াতে এক সুবিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন টলেমি। তৎকালীন পৃথিবীতে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারে যত পুস্তক ছিল তা আর কোথাও ছিল না। কিন্তু এত বিশাল গ্রন্থাগার সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য একজন যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করছিলেন এই গ্রিক শাসক।

ইরাটোস্থেনেসের সন্ধান পাওয়ার পর টলেমি তাকেই আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি ইরাটোস্থেনেস। এক সময় তিনি এই গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক হয়েছিলেন। গ্রন্থাগারিক হলেও ইরাটোস্থেনেস আসলে মনেপ্রাণে ছিলেন গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি প্রথম ‘ইরাটোস্থেনেসের ছাঁকনি’-এর মাধ্যমে যেকোনো সংখ্যার মধ্যে থেকে মৌলিক সংখ্যা বের করার পদ্ধতি বের করেন। মৌলিক সংখ্যা বের করার এই পদ্ধতিটি আজও গণিতে সমানভাবে সমাদর পেয়ে আসছে। তিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন ১ মৌলিক বা যৌগিক সংখ্যা নয়, তা একক সংখ্যা।

ইরাটোস্থেনেসের ছাঁকনি ব্যবহার করে ১০ মিলিয়ন পর্যন্ত সংখ্যার মধ্য থেকে সহজেই মৌলিক সংখ্যা গুলিকে আলাদা করে ফেলা যায়। বর্তমান সময়ে যে কোনো কম্পিউটারে মৌলিক সংখ্যা বের করার যে পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হয় তা আসলে ইরাটোস্থেনেসের ছাঁকনি। গণিতে বিপুল অবদান রাখার পাশাপাশি ইরাটোস্থেনেস জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে বসে থাকতে থাকতে একদিন তিনি লক্ষ্য করেন ২১ জুন তারিখটিতে পৃথিবীতে দিন সবচেয়ে বড় হয়। এই দিনে প্রায় বিষুব রেখার ওপর অবস্থিত মিশরের শহর সিয়েনে (বর্তমানে আসোয়ান) দুপুর ১২ টার সময় কোনো কাঠি পুঁতে রাখলে তার বিন্দুমাত্র ছায়া পড়ে না। অর্থাৎ এই দিন সূর্য বিষুব রেখার ঠিক ওপরে অবস্থান করে। কিন্তু তার কর্মস্থল আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি কাঠি পুঁতে রাখলে একই সময় খুব অল্প পরিমাণে হলেও ছায়া পড়ছে।

 

সিয়েন থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার দূরত্ব ছিল ৮০০ কিলোমিটার। ছায়া ও কাঠির মধ্যে কত ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন হচ্ছে তা হিসেব করে বার করে ফেলেন ইরাটোস্থেনেস। তার হিসেব অনুযায়ী ৭.২°কোণ উৎপন্ন হয়। সহজ হিসেবে বোঝা যায় পৃথিবীর পরিধি, অর্থাৎ 360° কোণের ক্ষেত্রে মোট দৈর্ঘ্য হবে (৩৬০×৮০০)/৭.২= ৪০,০০০ কিলোমিটার।

পৃথিবীর সঠিক পরিধি হল ৪০,২০০ কিলোমিটার। দেখা যাচ্ছে ইরাটোস্থেনেস প্রায় সঠিক হিসাব বের করেছিলেন তৎকালীন সময়ে। তার হিসেবে ভুল ছিল ২ শতাংশেরও কম। যা যথেষ্ট কৃতিত্বের বিষয়। অবশ্য সেই সময়ে প্রাচীন মিশরে দূরত্ব মাপার ক্ষেত্রে স্টেডিয়া-কে একক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সেই অনুযায়ী ইরাটোস্থেনেসের হিসেবে পৃথিবীর পরিধির দৈর্ঘ্য বেরিয়েছিল ২৫,০০০ স্টেডিয়া।

ইরাটোস্থেনেস জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর তিনটি বই লিখেছিলেন বলে আধুনিক ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন। কিন্তু রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিশর দখল করার সময় আলেকজান্দ্রিয়ার এই বিখ্যাত লাইব্রেরীতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তার ফলে বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সঙ্গে ইরাটোস্থেনেসের লেখা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বইগুলিও ভষ্মিভূত হয়ে যায়।

খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১২৫ সালে ৮১ বছর বয়সে ইরাটোস্থেনেস অফথালমিয়া নামক চোখের এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় অন্ধ হয়ে যান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার পক্ষে আর কোনো কাজ করা সম্ভব হবে না। এই জ্ঞানী দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্যের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে চাননি। নিজের ৮২ বছর বয়সে, খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৯৪ সালে স্বেচ্ছামৃত্যুর উদ্দেশ্যে উপবাস পালনের মধ্য দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। বর্তমানে তাকে সম্মান জানাতে চাঁদের একটি খাতের নাম রাখা হয়েছে ইরাটোস্থেনেস।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!