আগের পর্বে স্বদেশ নরওয়ে ছেড়ে বছর সতেরোর এক তরুণীর ইংল্যান্ডে পাড়ি দেওয়ার প্রসঙ্গই ছিল সিংহভাগ । বোর্ডিং স্কুলে থাকার অভিজ্ঞতা, আর তা ছেড়ে দিয়ে একটা সময় সেখানে ওয়াইডব্লুসিএ (ইয়াং উইমেনস’ ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন)-র আবাসিক হয়ে নাটকের প্রশিক্ষণ নেওয়া, সেইসঙ্গে ইংলিশ ভাষাশিক্ষার কথাও। উপরন্তু পরবর্তী জীবনে ওইরকম বয়েসেই নিজের মেয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষার ছবিও উঠে এসেছিল স্বতন্ত্র বিবরণে। এবারও তাঁর মেয়ে লিনের প্রসঙ্গ রয়েছে। বছর সাতেক বয়েসে তার বাবা ইংগমার বার্গম্যানের কাছ থেকে পাওয়া একটা সাইকেলে চড়ে মায়ের সঙ্গে ভ্রমণের সূত্রে। মেয়ের নতুন সাইকেল আর মায়ের পুরোনো সাইকেল দু-টি নিয়ে অনবদ্য এক আখ্যান বুনেছেন লিভ উলমান তাঁর এই আত্মকথার একাংশে। এ ছাড়াও রয়েছে অভিনেত্রী হয়ে ওঠার সূচনাপর্বের দিনগুলোর কথা। স্বাধীন মানসিকতাই যাঁর অল্পবয়েস থেকে একা যাপনের সাহসও জুগিয়েছিল নিজের লক্ষ্যে পৌঁছোতে। দিন গুজরানের জন্য অতি সাধারণ কাজও করতে হয়েছে কখনো। কবুল করেছেন, ‘মাঝে মাঝে কাজ জুটে যেত। ডাকটিকিট সাঁটা, খামে ঠিকানা লেখা— যা পাওয়া যায়।’ এমনকী নিজের অভিনেত্রী হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কোনোদিন কোনো সংশয় না থাকলেও, ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা অনিশ্চয়তার বোধও যে সক্রিয় ছিল, সেকথাও বলেছেন। কবি-অনুবাদক সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর তরজমায় ভিন্নসময়-এর পাঠকদের জন্য সেইসব বৃত্তান্তই রইল এবার একাদশ পর্বে।
সাইকেলদের কথা
আমাদের এক সাইকেল অভিযান।
এক মা, যার ওজন কমানো দরকার আর এক সাত বছরের মেয়ে, যে সদ্য বাবার কাছ থেকে তার দ্বিচক্রযানটি উপহার পেয়েছে। মেয়ের চেয়েও বেশিবয়েসি আমার পুরোনো লজ্ঝড়ে যন্ত্রটার পাশে ওরটা নীল, চকচকে, উঁচুদরের দেমাকে ঝলমল করেছে। একটা ঘণ্টি বাজছে জংধরা সুরে, অন্যটা জবাব দিচ্ছে মিহিগলায়।
বয়স্ক একটা বুক ভরে রয়েছে ভালোবাসা আর টনটনে অনুভূতিতে, ছোট্ট রোগা শরীরটা উদ্ধত ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে মোড় ঘোরার সময় পেছন ফিরে তাকাচ্ছে। ধুলোমাখা একটা হাত দুলে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি, ব্যগ্রভাবে। হাসিমুখ, যা প্রচ্ছন্ন গর্বকে ঠিক লুকোতে পারছে না।

আজ বসন্ত, বাবার কাছ থেকে ও একটা সাইকেল পেয়েছে, মায়েরও রয়েছে সময়।
আমাদের প্রায় সাধারণ কোনো পরিবারের মতোই দেখাচ্ছে।
মাঝে মাঝে পাশাপাশি চলছি আমরা। কথা বলছি পেরিয়ে-যাওয়া গাছেদের সঙ্গে। বসন্ত কাল হলেও রোদ্দুর কত চড়া, যেসব বুনোফুল বাড়ি নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের টেবিলে ফুলদানিতে রাখব— সেসব নিয়ে কথা নিজেদের মধ্যে।
আর যখন কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠছি, তখন ভান করছি যেন আমার বড়ো সাইকেলটার সঙ্গে ওর ছোটো সাইকেলটা গল্প করছে। কত কী ওদের আলোচনার বিষয়! আমার সাইকেল জানাচ্ছে ছোটোমেয়েটার জন্মের আগে পৃথিবী কীরকম ছিল। সে তখন থাকত অসলোর ঠিক মধ্যিখানে, ভয়ে ভয়ে। এত গাড়িঘোড়া ছিল, আর মেয়ের মাও রাস্তাঘাটের নিয়মকানুন সব জানত না। তাই তারা যখন বেরোত, সারাক্ষণ তাদের পিছু নিত কান-ফাটানো হর্ন আর রাগি গলার চিৎকার।
আরও পড়ুন
আমরা যারা নরওয়ে থেকে এসেছি এই প্রথম টেলিভিশন দেখলাম

তারপর সে গেল সুইডেনের এক দ্বীপে, যেখানে প্রায় কোনো যানবাহনই ছিল না। মা জঙ্গলের সুঁড়িরাস্তাগুলো দিয়ে সাইকেল চালাতে ভালোবাসত। এত সরু সেসব রাস্তা যে, মাঝেমধ্যেই আঁচড় লেগে রং চটে যেত।
এখন এই বয়েসে গ্রামে থাকাটাই ভালো, যেখানে কাজে লাগা যায়। কেননা বেবি-সিটার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন— সবাই ভরসা করে তাকে ধার নেয়।
এ-ই বেশ। সেলারে পড়ে থেকে থেকে জং ধরার চেয়ে।
‘আর তোমার খবর কী, ছোট্টো সাইকেল?’
একটা সরু গলা বোঝাতে শুরু করে, এই তো সবে তার প্রথম বসন্ত, পাছে পড়ে যায় বা রং চটে যায় ভেবে একটু একটু ভয় পায় সে।
আমার সাইকেল অন্যটিকে আসন্ন শীতের কথা শোনায়। শোনায় কোদাল, ঠেলাগাড়ি আর বাগান-চেয়ারের সঙ্গে অন্ধকারে থাকাটা কী একলা লাগার! বোঝাই যায় না কখন বসন্ত এলে আবার কাজকর্ম শুরু হয়ে সেলারের দরজা খুলে যাবে। শীতকালে কেবল ঘুমের ভান করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তার পছন্দ। যতই হোক, কোনো ঠেলাগাড়ির সঙ্গে তো আর কথাবার্তা চালানো যায় না!
মাঝেমধ্যে হ্যামকটার দিক থেকেও কান বন্ধ করে রাখতে হয়— যার সবে বছর খানেক বয়েস, মস্ত, নীলরঙা, ভারিক্কি— সারাক্ষণ তাকে অবজ্ঞা করে, তার কিনা রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, জিনিসপত্তর রাখার ঝুড়িটাও আর নেই!
আরও পড়ুন
ঠাকুমা আমায় দেখতে শিখিয়েছিল একটা পাতার শিরা কেমন দপদপ করা জীবন্ত
লিন বলে ওঠে, ‘ও মা, আমরা একটা ঝুড়ি আর যন্ত্রপাতির বাক্স কিনে নিতে পারি না?’
আমি অমনি আমার সাইকেলকে দিয়ে বলাই, তার এত বয়েস হয়ে গেছে যে, সে আর অতসব মালপত্তর বইতে পারবে না।
পেরিয়ে যেতে যেতে গাছেদের সঙ্গে কথা বলি। এখনও পাতা গজায়নি বলে তাদের যে এমন ন্যাড়া, ওজনদার, মস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, সেজন্যে সান্ত্বনা দিই।
লিন তাদের জিজ্ঞেস করে, ‘রাত্তিরে বাইরে থাকাটা কি খুব ভয়ের?’
ঘড়ঘড়ে গলায় একটা গাছ উত্তর দেয়, ‘না, না, আমরা তো সবাই একসঙ্গে থাকি। অন্ধকার হয়ে গেলে বাগানের বেড়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা একটা সাইকেলের পক্ষে আরও বিপজ্জনক, যখন লিন শুয়ে পড়ে, তার ওপর নজর রাখতে পারে না।’
‘মা, তোমার কি মনে হয় সাইকেলের ভয় করে?’
বড়ো সাইকেল জানায়, অন্ধকার ঝোড়ো রাত্তির একটু ভয় পাওয়ার মতো বটে। তখন মাঝে মাঝে খুব একলা লাগে।
লিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, ‘ও মা!’
তারপর আমরা বাড়ি ফিরি। মেয়েটা ভেতরে যেতে চায় না।
সিঁড়ির ওপর বসে বুড়ো বিচ্ছিরি সাইকেলটাকে চাপড়াতে থাকে। ওর চোখ ছলছল করে। আর আমাকে ওর পাশে বসে বোঝাতে হয় আমরা আসলে খেলছিলাম।এই সব কিছুই বানানো।
অনেকক্ষণ বসে থাকি আমরা। পেছনগুলো ঠান্ডা কনকনে হয়ে যায়।
শেষকালে বড়ো সাইকেলটাকে বলতেই হয়, এবার সে একটু শান্তিতে থকতে চায়। একা থাকলে তার চিন্তা করতে সুবিধে হয়। তা ছাড়া, সত্যি সত্যি তো আর রাত্তিরে তার ভয় করে না বা একা লাগে না! নজর কাড়ার জন্যেই সে ওসব বলে। গাছেরা খুবই বন্ধুর মতো, বাড়ির চারপাশের ফারগুলো তো প্রায়ই তার সঙ্গে গল্প করে।
রাতে খাওয়ার সময় লিন বার বার জানলার দিকে ছুটে যায়— গাছগুলোকে আর দুটো সাইকেলকে দেখে। কিন্তু আমরা আর তাদের নিয়ে কথা বলি না। তখন টেলিভিশনে ছোটোদের একটা অনুষ্ঠান শুরু হয়। তারপর বই পড়ে শোনানো, রাতের প্রার্থনা।
তার গায়ে যখন ঢাকা দিয়ে দিই, সে ঘুমিয়ে পড়ে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি, যেন খারাপ স্বপ্ন দেখছে।
আমি শুতে যাওয়ার আগে একটা পুরোনো আর একটা নতুন সাইকেল প্যাসেজের ভেতর গড়িয়ে আসে, যেখানে আলো আর উষ্ণতা, বাইরের পোশাক-আশাক আর খয়েরি পাথর-বসানো সুন্দর সবুজ টেবিলটা রয়েছে।
এখন থেকে প্রতিরাতে ওরা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। সাবধানের মার নেই, বলা তো যায় না…
বসন্ত আর নাটক
‘ডল্স হাউস’ নিয়ে দ্য নরউইজিয়ান থিয়েটার নানা জায়গায় শো করে বেড়াচ্ছে।
এ বছর বসন্ত এসেছে তাড়াতাড়ি। উষ্ণ, আরামদায়ক, গ্রীষ্মের মতো তাকেও বরণ করে নেওয়া হচ্ছে পাতলা জামা পরে।
আমরা আমরা হারড্যাঙ্গের দিয়ে যাচ্ছি। এত সুন্দর, ভেতরে কেমন কষ্ট হয়। জানতাম না আমার দেশ এমন। স্থির ঝলমলে ফিয়োর্ডের জলে পাহাড়ের ছায়া, পাহাড়গুলো রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশের দিকে ঊঠে গেছে। মাঝে মাঝে বরফ জমে রয়েছে ছায়াঢাকা ঢালুগুলোর ওপর। এই পথ চলে গেছে কতশত ঋতুর ভেতর দিয়ে।
ফল হয়ে যা ফলবে,তা এখন মনোহরণ ফুল হয়ে ফুটে আছে। পাহাড়ের গা ক্রমশ নরম হালকা রঙে আরও ভরে উঠছে, যেখানে অদেখা সব বুনোফুলের লাল-নীল-হলুদ থরেবিথরে ছড়ানো। জানলা খুললে আপেল আর চেরিফুলের সুঘ্রাণ ভেতরে ঢুকে সবাইকে মাতাল করে তোলার আগেই তাকে যেন চোখ দিয়ে ছোঁয়া যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ ধরে ওপরদিকে উঠছি। বরফে-মোড়া সব পাহাড় আমাদের ঘিরে রয়েছে, যারা এইমাত্র পেরিয়ে-আসা বসন্তের খবর পায়নি।
সংকীর্ণ পাকদণ্ডী চলেছে। এগোনোর জন্যে মাঝে মাঝে বাসটাকে পিছিয়ে নিতে হচ্ছে, পেছনের চাকাগুলো ঝুলছে প্রায় পথের কিনারায়।
পাহাড়ের গা বেয়ে বন্য উল্লাসে নেমে আসছে বিপুল ঝরনাগুলো, গা থেকে বরফের আস্তরণ সরে যাওয়ার আনন্দে যেন দিশেহারা। আলোয় বদলে যাচ্ছে বর্ণালি— সমুদ্রের দিকে চলা কোটি কোটি হিরের কুচি।
‘আঃ, এই নরওয়ের জন্যে শত কষ্টও সহ্য করা যায়!’
আরও পড়ুন
কোথায় যেন পড়েছিল কোনো বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের পক্ষে যৌন অভিজ্ঞতা না-থাকাটা ক্ষতিকর
সঙ্গে আমাদের নিজেদের অর্কেস্ট্রা রয়েছে, এই সুন্দরের উদ্যাপন আমরা করতেই পারি। আমার পাশে এক বেহালাবাদক— শীর্ণ, অস্থিসার, চিবুকের নীচে বেহালা। আজ আমার ‘হারড্যাঙ্গেরের বিবাহযাত্রা’ শোনার অভিজ্ঞতা হল, বুঝতে পারলাম হারড্যাঙ্গের-বেহালার মধ্যে দিয়েই কীভাবে নরওয়ের আত্মা প্রাণ পায়।*
সে-ই তো সুখী, যার একদিন কাটে সানফ্রানসিস্কোতে গাছে থেকে সদ্যপাড়া কমলালেবুর রস পান করে, গায়ে-মুখে আদরের মতো উষ্ণ আবহাওয়াকে ছুঁয়ে যেতে দিয়ে— আর পরের দিনই যে একটা ছোটো নৌকো ধরবে বলে হেঁটে চলে, নৌকোর আগগলুইয়ে দাঁড়িয়ে এক নরউইজিয়ান ফিয়োর্ডের দিকে ভেসে যায় এই জেনে যে, সে এই পরিপূর্ণতারই একটা অংশ।
আমাদের দলের বাসে আমরা তিন জন যাত্রী একই বছরে থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হওয়ার অডিশন দিয়েছিলাম। এক জনও সফল হইনি। এখন সন্ধেবেলা আমাদের দেখা হয় মঞ্চের ওপর, প্রধান সব ভূমিকায়। আমাদের ব্যর্থতাগুলো পড়ে আছে অনেক দূরে, কত কী ঘটে গেছে তারপর। বাসে বসে আমরা স্মৃতিচারণ করি।
‘কেমন লেগেছিল?’
‘সেবার কে ভর্তি হতে পেরেছিল মনে আছে?’
‘তারপর কী করলে? সেই রাত্তিরে? পরের মাসগুলো?’
আমরা হেসে উঠি। একদিন যাতে অত মনখারাপ হয়েছিল, তা-ই নিয়ে মজা করি একসঙ্গে।
————————
*হারড্যাঙ্গেরের বেহালা (Hardanger fiddle): নরওয়ের জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। প্রচলিত বেহালার চারটি তারের বদলে এতে আটটি বা ন-টি তার থাকে। এটি নাচের সহযোগী যন্ত্র হিসেবে বাজানো হয়, বিশেষত চার্চের উদ্দেশে বিবাহযাত্রার সময়।
যখন একা
বয়েস আঠেরোর দিকে যাচ্ছে, লন্ডনের অভিনয় শিক্ষার পর অসলোতে চলে এলাম। মনে দৃঢ়বিশ্বাস, প্রায় সব কিছুই শিখে গেছি। নিজের অভিনেত্রী হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কোনোদিনই কোনো সংশয় ছিল না।
কিন্তু খুব ভেতরে কোথাও একটা অনিশ্চয়তার বোধ কাজ করছিল। ট্রোন্ডহাইমের স্কুলের জন্যে মন-কেমন করত, যেখানে স্কুল-পড়াশুনো-বাড়ি-আত্মীয়স্বজনের নিরাপত্তার ভেতরে থেকে বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্যে তৈরি হচ্ছে।
জীবনে এই প্রথম একেবারে একা থাকতে চলেছি। আলাদা দরজাওয়ালা একঘরের একটা ফ্ল্যাট আমার, মনে বিশ্বাস—এবার থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হব।
জুলিয়েট আর ওফেলিয়ার চরিত্রে অডিশন দিয়ে একটা করিডরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, কখন মনোনীতদের নামের তালিকা টাঙানো হবে। যখন সেটা হল, একটা ঢ্যাঙা বেঢপমতো ছেলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নামগুলো পড়তে লাগল। আমার নাম যে নেই, এটা বুঝে গিয়ে যখন মরমে মরে যাচ্ছি, ছেলেটা শেষনামের আগের নামে এসে হঠাৎ থমকে গেল। বুঝলাম সে নির্বাচিত হয়েছে। হাসল কি হাসল না, যেন কিছুই হয়নি, এইভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তারপর বহুবছর ধরে তার উত্থান-পতনের দিকে নজর রেখে গেছি। তার সাফল্যের মধ্যে যেন আমার ব্যর্থতার একটা কারণ খুঁজতাম। আজ সে সুইডেনের এক মৎস্য ব্যবসায়ী। শোনা যায় নিজেকে নিয়ে দিব্যি আছে সে।
আরও পড়ুন
আমি ছুটছি আরেক জগতের দিকে, যাকে আমি সবসময় স্বীকার করি না
করিডরে বহুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, যতক্ষণ না সফল দশ জনের নাম মুখস্থ হয়ে যায়। পুরোনো ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা নেড়ে গেল। তারপর আমি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আহত মন আর এইভাবেই যে জীবনটা কাটবে, সেই ভয় নিয়ে সারারাত ধরে হাঁটলাম। ঠিক সেই নাচের স্কুলের মতো, যেখানে নির্বাচিতরা বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে যেত। যেখানে গোলাপি পোশাকপরা একটা হেরে-যাওয়া মেয়ে মেয়েদের বাথরুমে দাঁড়িয়ে কাঁদত।
আমি ছাড়া আরও যে অনেকে সেদিন সফল হতে পারেনি, সে-কথা মাথাতেই আসেনি। ভাবিনি, বহুদিন পরে একটা নাট্য-সফরের বাসে সেসব সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে দেখা হতে পারে, কৌতুক আর দূরত্ব নিয়ে আমরা সেই তরূণ বয়েসটার দিকে ফিরে তাকাতে পারি।
সেদিন পাশে ছিলেন শুধু ঠাকুমা। সকালে প্রাণ খুলে কাঁদলাম তাঁর কাছে গিয়ে। আমার ভেতর যে-স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, কখনো তেমন স্বপ্ন না-দেখা একটা বুকের ওপর পড়ে ফোঁপাতে লাগলাম। যা-কিছু রোজকার, যা-কিছু চেনা— একরাতের মধ্যে সব দূরে সরে গেল। আমি এসে দাঁড়ালাম এক বাঁক নেওয়ার মোড়ে। এই ঘটনা থেকে কিছু শেখার ছিল, যা বুঝে ওঠা শক্ত— প্রত্যেককে তার নিজের ভাগ্য বয়ে নিয়ে চলতে হয়, সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর যা নির্ভর করে না।
সেই অনুভূতি গড়ে ওঠে দীর্ঘ সময় ধরে। দুঃখকে গ্রহণ করতে পারা, তাকে বেঁচে থাকার, বেড়ে ওঠার, বদলে যাওয়ার অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া।
আরও পড়ুন
তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা
অসলোয় কাটানো প্রথম বছর। মনে আছে, তখন প্রথম কয়েক মাস নিঃসঙ্গতাই ছিল আমার সঙ্গী। যখন যথেষ্ট যোগ্য না-হওয়া, যথেষ্ট প্রতিভাবান না-হওয়া বিরাট দুঃখের ব্যাপার ছিল। লক্ষ্যহীন অর্থহীন মাসগুলো যেন ফুরোতেই চাইত না। এখনও আমার কাছে সেই নীল ডায়েরিটা রাখা আছে, যাতে অনেকদিন আগের এক কমবয়েসি মেয়ে সযত্নে সেসব কথা লিখে রাখত। সেইসব মনোবেদনা, যা আজ আর মনে পড়ে না, সেইসব হর্ষ— যা আজ আর আমার নয়।
বারো ফুট বাই বারো ফুট একটা অ্যাপার্টমেন্ট। ছিরিছাঁদহারা দিন। কুস্বপ্নে-ভরা লম্বা সব রাত। সকালে জেগে ওঠা আর রাতে একলা লাগার মধ্যে দুস্তর একা সময়।
প্রত্যেক দিন আমার নির্দিষ্ট জায়গা ছিল একটা লাইব্রেরি। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা যা পড়তাম,তার নিখুঁত নোট নেওয়া। মস্ত চুপচাপ ঘর। এমন এক জায়গা, যেখানে হয়ে ওঠা যায়, যাকে আপন করা যায়।
সেখানে ছিল ছাত্ররা, ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ আর গৃহবধূরা। শীতকালে আসত ঠান্ডায় জমে-যাওয়া ভবঘুরে লোকজন। লাইব্রেরি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত একটা খবরের কাগজ নিয়ে বসে থাকত, যার পর আবার শুরু হত নৈশ আশ্রয়ের খোঁজ।
কেউ কারও সঙ্গে কথা বলত না— পাশেরজনের সঙ্গে তৈরি হত না কোনো যোগাযোগ, অন্যরা যাতে বিরক্ত না হয়, তার দিকে যাতে নজর না ফেরায়, সেইজন্যে প্রত্যেকে পাতা ওলটাত সাবধানে।
আরও পড়ুন
একটা বই লেখার চেষ্টা মাত্র আমার সাংসারিক দায়িত্বপালনের অক্ষমতাকে পুষিয়ে দেয় না
একদিন আমি রাস্তার ওপারের দোকানে চা খাচ্ছি, আমার চেয়ে একটু বড়ো একটি মেয়ে এসে আমার টেবিলে বসল। ঘণ্টা খানেক কথা বললাম দু-জনে। বস্তুত কথা বলছিল সে-ই, খেয়াল করেনি যে আমি এক লাজুক, কৃতজ্ঞ শ্রোতামাত্র। প্রতি সপ্তাহে সেই টেবিলটায় গিয়ে বসতাম। কল্পনা করতাম দু-জনে মিলে কত কী করছি। সে কিন্তু আর ফিরে আসেনি।
মাঝে মাঝে কাজ জুটে যেত। ডাকটিকিট সাঁটা, খামে ঠিকানা লেখা— যা পাওয়া যায়। তেমন-সব সময়ে রোজ রাতে ডিনার খেতাম, বাড়িতে লিখতাম আমার অভিনয়জীবন কেমন সুন্দরভাবে এগিয়ে চলেছে।
(আগামী শনিবার সমাপ্ত)