১৯ এপ্রিল, ২০২৪শুক্রবার

১৯ এপ্রিল, ২০২৪শুক্রবার

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে

লিঙ্গরাজের উৎসব 

জাপানিদের বসন্তকালীন উৎসব কানামারা মাতসুরি। প্রতিবছর এপ্রিল মাসের প্রথম রবিবার পালন করা হয়। সে হিসেবে এই দু-হাজার একুশে প্রথম রবিবার হচ্ছে ৪ তারিখ। গতবছর ছিল ৫ তারিখে, আর সামনের বছর হবে ৩ তারিখে। তোকিও শহরের দক্ষিণে কাওয়াসাকি, সেখানেই মূল অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

 

‘কানামারা মাতসুরি’র আক্ষরিক অর্থ ‘ইস্পাতলিঙ্গ উৎসব’। আর সে উৎসবের প্রধান হয়ে আছে পুরুষাঙ্গ। তার দরুন যাবতীয় সাজসজ্জা, ছবি, ললিপপ জাতীয় শৌখিন খাবার, এমনকী মুলো আর গাজরের মতো সবজিতেও শিশ্নরূপ দেওয়া হয়। একাধিক লিঙ্গরূপ নিয়ে চলে শোভাযাত্রা, কাঁধে-নেওয়া পালকিতে তার অধিষ্ঠান, ‘মিকোশি’ বলা হয় জাপানিতে।

আরও পড়ুন
হিন্দুদের হিংলাজেশ্বরীই পাকিস্তানের আদরের ‘নানী কি হজ’, ৫১ পীঠের অন্যতম মরুতীর্থ হিংলাজ

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
কানামারা মাতসুরিঃ লিঙ্গরাজের উৎসবে জনতা

জনপ্রিয় এই উৎসবের সঙ্গে এক লোককথারও খানিকটা যোগ আছে। যদিও তাকে ‘জাপানি লোককথা’ বলা হয় ঠিকই; কিন্তু তার সঙ্গে খোদ জাপানিদের চেয়ে আসলে সেখানকার আদিবাসী ‘আইনু’দের যোগই বেশি। যারা দীর্ঘদিন ধরেই সংখ্যালঘু নয় শুধু, সংরক্ষণের পর্যায়ে চলে এসেছে। তাদের লোককথা দীর্ঘকাল আগে সংগ্রহ করেছিলেন ব্রিটিশ জাপানবিদ বাসিল হল চেম্বারলেন (১৮৫০-১৯৩৫)। সেখানে ‘মেয়েদের দ্বীপভূমি’ নামে যে গল্পটি আছে, তার বয়ান কিছুটা আলদা, তবে চালু গল্পের মূল বিষয়ের সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়।    

 

যাই হোক, বলা হয়, কোনো দাঁতাল দৈত্য নাকি এক মহিলার প্রেমে পড়ে তার যোনিতে লুকিয়েছিল। কিন্তু সেই মহিলার সঙ্গে আলাদাভাবেই দু-জন পুরুষের বিয়ে হলেও, বিয়ের রাত্তিরে দু-জনেরই লিঙ্গ খেয়ে ফেলে সেই দৈত্য। ভয়ংকর ওই দৈত্যের হাত থেকে রেহাই পেতে মহিলা এক কামারের শরণাপন্ন হয়ে লোহার লিঙ্গ তৈরি করিয়ে তার দাঁত ভাঙে। সেই সূত্রেই নাকি কাওয়াসাকির কানায়ামা মন্দিরে লিঙ্গের প্রতিষ্ঠা।     

আরও পড়ুন
জাপানের সুকিজি : পৃথিবীর বৃহত্তম মাছ বাজার, গত বছর বন্ধ হয়ে গেলো এই কারণে!

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
মিকোশির সঙ্গে শামিল লোকজন

উৎসবের অমন অদ্ভুত নামের মূলে এই লোককথার ভূমিকা যা-ই থাক-না-কেন, রোগ-বিশেষ নিরোধের বা তার জন্য প্রতিরোধের উপায়-চিন্তার কোনো সম্পর্ক হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। দীর্ঘকাল ধরেই সে চেষ্টা হয়ে থাকবে। সাধারণ লোকজনের প্রার্থনা এখানে সন্তানকামনায়, সাবলীল বৈবাহিক জীবনের আশায়, বা ব্যাবসায় সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা নিয়েই চলতে থাকে।   

কানায়ামা মন্দির                                                       

কাওয়াসাকির ওয়াকামিয়া হাচিমাঙ্গু মন্দির এলাকার ভেতরই রয়েছে ‘কানায়ামা মন্দির’। মন্দিরটি কানায়ামা হিকো-নো-কামি আর কানায়ামা হিমে-নো-কামির উদ্দেশে উৎসর্গীত। এঁরা নাকি প্রথমদিকে খনিখনন আর কামারদের রক্ষক ছিলেন। পরে এই দেবযুগল আবার রতিরও দেবতা হয়েছিলেন। তারও একটা ইতিবৃত্ত হয়তো পাওয়া যাবে। বলা হয়, অগ্নিদেবতার জন্ম দেওয়ার সময় শিন্তো ধর্মের দেবী ইজানামি-নো-মিকোতোর শরীরের নীচের অর্ধাংশ খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন ওই দেবযুগল তাঁর ক্ষত সারিয়ে তোলেন। সেই পৌরাণিক কথার  গুঞ্জনেই হয়তো তাঁদের কিছুটা রূপান্তর ঘটে থাকবে জনমানসে। সন্তানপ্রাপ্তিতে দৈবানুকূল্য আর সাবলীল বৈবাহিক সম্পর্কের কামনাই লোকজনের প্রধান প্রার্থনা হয়ে উঠেছে সেখানে তাঁদের উদ্দেশে।   

 

কেবল বিবাহিতরাই যে সন্তানকামনায় ওই মন্দিরে এসে উৎসবে যোগ দেন তা নয়। বিভিন্ন জাতির বহু ধরনের লোকজনই আসেন প্রতিবছর। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে-কেউই এই উৎসবে অংশ নিতে পারেন।  

আরও পড়ুন
আত্মহত্যা করার একটি জনপ্রিয় স্থান জাপানের আওকিগাহারা বন

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
কানায়ামা মন্দির

জাপানের ইতিহাসে সতেরো থেকে উনিশ শতক, মোটামুটি শ-আড়াই বছরের (১৬০৩-১৮৬৮) মতো ‘ইদো আমল’ হিসেবে পরিচিত। কানায়ামা মন্দির তখনই গড়ে ওঠে। ওই সময় যাঁরা বংশপরম্পরায় সৈন্যপাল হতেন, তাঁদের বলা হত ‘শোগুন’। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় এঁরা সামরিক সরকারের প্রধান হিসেবেই দেশশাসন করতেন। ‘তোকুগাওয়া শোগুনরাজ’ এবং সারাদেশে শ-তিনেকের মতো ভূমির অধিকারী বা জমিদার যাঁরা, আঞ্চলিক শাসক বা ‘দোইমিয়ো’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ‘ইদো আমল’ তাঁদেরই মিলিত শাসনকাল হিসেবে পরিচিত। ওই সময়কার ব্যাবহারিক জীবনের অনেককিছুই পরবর্তীকালেও বর্তেছে। ভালো-মন্দ মিশিয়েই ‘ইদো আমল’ তাই গুরুত্বপূর্ণ।   

 

তখনকার জাপানের প্রধান পাঁচটি সড়কের ভেতর অন্যতম ছিল তোকাইদো সড়ক। কিয়োতোর সঙ্গে ইদোর (বর্তমান তোকিও) সরাসরি যোগাযোগে ওটি গুরুত্বপূর্ণ হয়েও উঠেছিল। কাওয়াসাকি অঞ্চলের অনেক সরাইও ছিল ওই তোকাইদো সড়কে। ওখানে গণিকালয়ও গড়ে উঠেছিল। বলা হয়, যেসব মহিলা ওইসব সরাইয়ের কর্মী ছিলেন, তাঁরা ছাড়াও অনেক গণিকা নিজেদের দুর্ভাগ্য আর যৌনব্যাধি থেকে মুক্তির আশায় কানায়ামা মন্দিরে আসতেন। এ ছাড়াও প্রসবকালীন সংকটমুক্তির আশায়, এমনকী বিয়ে এবং সুখী দাম্পত্যের আশাতেও প্রার্থনা কিছু কম নয় আজও।       

আরও পড়ুন
সুতমু ইয়ামাগুচি— একমাত্র ব্যক্তি যিনি হিরোশিমা এবং নাগাসাকি উভয় পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন

সাবেক যুগের কাওয়াসাকির তোকাইদো সড়ক

যৌনরোগমুক্তির আশায় একালেও ওই মন্দিরে রাতের দিকে অনেকে আসেন প্রার্থনা করতে। তবে মনে হয় না, ওখানে লোকজনের যাতায়াত কেবল প্রার্থনাতেই কোনোকালে সীমাবদ্ধ থাকার মতো ছিল। সংশ্লিষ্ট কারও সূত্রে ওখানে নিরাময়ের ভেষজ প্রাপ্তির সুযোগ থাকাটাও অসম্ভব নয়। কেবল দেব-দেবীর মুখ চেয়ে লোকে ভিড় করত না হয়তো। নিরাময়ের পরেও সেখানে আসত অনেকে।   

উৎসবের প্রত্যাবর্তন

সতেরো থেকে উনিশ শতকের ভেতর ‘ইদো আমল’এ কানায়ামা মন্দিরে প্রথম দিককার উৎসবগুলোয় যা-ই হোক-না-কেন, উনিশ শতকের শেষদিকে তা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন কোনো উদ্যোগ না থাকলেও, ১৯৬৯-৭০ নাগাদ ওখানকার প্রধান পুরোহিত হিরোহিকো নাকামুরা ফের তা চালু করার কথা ভাবেন। ছোটো আকারেই, রাত্তিরে। সেই থেকে নয় নয় করে বছর পঞ্চাশ তো হয়ে গেল। দিন-কে-দিন তার জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে এখন হাজার পঞ্চাশের মতো সমাগম হয় প্রতিবছরে। সংবাদমাধ্যমের নজরে থাকায় আন্তর্জাতিক প্রচারও পেয়ে গেছে।    

 

জনপ্রিয়তার কারণও আছে। সাধারণের ক্ষেত্রে রোজকার নিয়মতান্ত্রিক জীবনের গ্লানি থেকে মুক্তির উপায় যেমন, আরেকদিকে তেমনই প্রান্তিক যে-গোষ্ঠী,‘এলজিবিটি’ হিসেবে গণ্য যাঁরা, জাপানি রক্ষণশীল সমাজের চাপ থেকে তাঁদেরও মুক্তির অন্যতম উপায় এই ‘কানামারা মাতসুরি’। সাজসজ্জা বদলে পুরুষ-নারী তাঁদের  উভয়পক্ষেরই ভালো রকমের যোগদান ঘটে এখানে। কাঁধে ‘মিকোশি’ নিয়ে শোভাযাত্রায় তাঁরাও থাকেন।

আরও পড়ুন
সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে প্রতি বছর চলে নৃশংস ডলফিন হত্যার উৎসব, জানলে শিউরে উঠবেন আপনিও

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
কানামারা ফুনামিকোশি

বহু মানুষের জমায়েতে উৎসুক জনতার প্রধান আকর্ষণ ‘মিকোশি’ বা কাঁধে বহনযোগ্য পবিত্র লিঙ্গ। এটি দেখতে যাঁরা ভিড় করেন, তাঁদের ভেতর প্রায় ষাট শতাংশই নাকি বহিরাগত।  

জিবেতা আর হোনেন মাতসুরি                                              

এপ্রিলের শুরুর দিকে আবার কাওয়াসাকিতেই ‘জিবেতা মাতসুরি’ বা ভূমি উৎসবও হয়ে থাকে। মাটিতে বাঁশের কোঁড় দেখা দিলে বসন্তে ওই উৎসব পালন করা হয়। বাঁশবনে, বা একটু কোমল করে বললে বেণুকুঞ্জে বসে লোকজন বনভোজন করে। বাঁশের চারার মতো জীবিনীশক্তি লাভের আশায় তাঁদের ওই উদ্‌যাপন। এদিক থেকে ‘জিবেতা মাতসুরি’কে কেউ কেউ কানামারা মাতসুরির উৎস হিসেবেও বিবেচনা করেছেন।    

 

আবার উচ্চফলনের বা ফসলের সমৃদ্ধির আশায় জাপানিরা প্রতিবছর মার্চ মাসের ১৫ তারিখে ‘হোনেনসাই’ উৎসবও পালন করেন। প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনাই জাপানের প্রাচীন শিন্তো ধর্মের মূলকথা। সেদিক থেকে ফসলের সমৃদ্ধির জন্য ‘হোনেন মাতসুরি’ উদ্‌যাপনও তাঁদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।   

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
হোনেন মাতসুরিতে মহালিঙ্গ নিয়ে শোভাযাত্রা

সেখানকার অন্যান্য উৎসবে্র মতো এক্ষেত্রেও শোভাযাত্রা হয়। দু-আড়াই-শো বছরের পুরোনো জাপানি সাইপ্রেস কাঠে তৈরি আড়াই মিটার লম্বা, দু-শো আশি কেজি ওজনের ‘ইউবুত্‌সু’ (পুরুষাঙ্গ) বা ‘উয়াসে-গাতা’টি (মহালিঙ্গ) নিয়ে পরিক্রমা হয় কোমাকি শহরে। জোড় সংখ্যার বছরে সেখানকার ‘সিনমেই-শা’ মন্দির থেকে, নয়তো বিজোড় সংখ্যার বছরে ‘কুমানো-শা’ মন্দির থেকে সেই মহালিঙ্গ আনা হয় ‘তাগাতা জিনজা’ বা তাগাতা মন্দিরে।               

  

মোটামুটি বেলা দশটা নাগাদ লোক জড়ো হতে শুরু করে তাগাতা জিনজায়। বিভিন্ন ধরনের খাবার, স্মারক দ্রব্য (অধিকাংশই শিশ্নাকৃতি বা ওইরকমের) বিক্রি হতে থাকে। কাঠের বিশাল ব্যারেলে ধেনো মদ রাখা থাকে, বিনা পয়সায় বিলি হয়। বেলা দুটো নাগাদ সিনমেই-শা মন্দিরে লোকজন জড়ো হলে, শিন্তো পুরোহিত তাঁর ধর্মীয় কৃত্য সারার পর সেই মহালিঙ্গ নিয়ে শোভাযাত্রার শুরু। তাগাতা জিনজায় নিয়ে আসার পর লোকজন জড়ো হয় মন্দিরের বাইরের চত্বরে, ‘মোচি ন্যাগে’র প্রাপ্তির আশায়। ‘মোচি’ হল বিশেষ ধরনের জাপানি চালের পিঠে, আর ‘ন্যাগে’ হল ফেলা। ধর্মীয় শোভাযাত্রায় বা বিশেষ কোনো জমায়েতে আমাদের এখানে যেমন বাতাসা ছুঁড়ে ‘হরির লুট’ দেওয়া হয়। ওখানেও সেরকম তাগাতা জিনজার বাইরের চত্বরে উঁচু মঞ্চ থেকে জনতার উদ্দেশে ‘মোচির লুট’ দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান মিটতে বেলা সাড়ে চারটে-পাঁচটা হয়ে যায়।   

আরও পড়ুন
টুইটার ব্যবহার করে শিকার খুঁজে নিত জ্যাক দ্য রিপার এই সিরিয়াল কিলার, গতকাল দেওয়া হল ফাঁসির আদেশ

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
হোনেন মাতসুরিতে ধেনো মদ বিতরণ                                কানামারা মাতসুরির সাজ

 

লিঙ্গরাজের শোভাযাত্রা

কানামারা মাতসুরি-তে আবার একটা নয়, তিন-তিনটে লিঙ্গরূপ নিয়ে শোভাযাত্রা চলে। উৎসবের দিন কাওয়াসাকির কানায়ামা মন্দির ছাড়াও ওই চত্বরেই প্রদর্শনী কক্ষেও লোকজনের সমাগম হয়। অন্যসব দেশের কামের প্রতিমূর্তি বা প্রতিমা, যৌনবস্তু, সে-প্রসঙ্গের বইপত্রও রাখা থাকে প্রদর্শনীতে। জাপান ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের কামোৎসব ও তার দেব-দেবী প্রসঙ্গেও এখানে এলে জানতে পারেন দর্শক।    

 

উৎসবের মূল আকর্ষণ শোভাযাত্রা। তারই জন্য রীতিমতো মেলা বসে যায় পথের ধারে। বিভিন্ন খাবারের আয়োজন। অণ্ডকোষ-সহ শিশ্নাকৃতি নানারকম ক্যান্ডি বা ললিপপ, দীর্ঘক্ষণ চুষে খাওয়ার মতো মিষ্টদ্রব্যের ছড়াছড়ি সে মেলায়। উপরন্তু সবজির ভেতর মুলো আর গাজরকেও শিশ্নরূপ দিয়ে বিক্রি করা হয় সেখানে। সবেরই দাম চড়া। কিন্তু উৎসবে আসা জনতার তাতে কুছ পরোয়া নেহি। চড়া দামে সে-মেলায় সবই বিকোয়।

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
উৎসবের ললিপপ

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
উৎসবে শামিল জনতা

মোটামুটি দুপুর বারোটা নাগাদ শোভাযাত্রা শুরু হয়। বহনযোগ্য তিনটি  লিঙ্গরূপ বা ‘মিকোশি’ সেই শোভাযাত্রায় একে একে আসতে থাকে, আর জনতার উল্লাসে মুখর হয়ে ওঠে চতুর্দিক।   

প্রথমে মাথায় ছাউনি-দেওয়া নৌকো আকৃতির যে-পালকি বা মিকোশি-টি আনা হয়, ‘কানামারা ফুনামিকোশি’ নামে সেটি খ্যাত। তার ভেতর ঘন কালো রঙের লোহার উচ্ছ্রিত একটি লিঙ্গরূপ বসানো থাকে। এর দাতা সংস্থা হিতাচি জোসেন করপোরেশন।     

 

তার পরে যে-লিঙ্গরূপটি আনা হয়, তার রং ঘন গোলাপি। সেটিকে ‘এলিজাবেথ মিকোশি’ বলা হয়। এটি খোলামেলা, কোনো ঘেরাটোপ নেই এতে। এটির দাতা সংস্থা ‘এলিজাবেথ কাইকেন’ তোকিওর এক ‘ক্রসড্রেসিং ক্লাব’ বা ‘ড্র্যাগ ক্লাব’।

আরও পড়ুন
উলূপী আর অর্জুনের সন্তান ‘ইরাবান’কে কেন্দ্র করে ‘কিন্নর’দের নিজস্ব পার্বণ আরাবান উৎসব   

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
যাত্রার প্রস্তুতি, সামনে কানামারা ফুনামিকোশি, পেছনে এলিজাবেথ মিকোশি

ছেলেদের মেয়ে সাজা, বা প্রয়োজনে তার উলটোটাও দীর্ঘকাল ধরেই যাত্রা-থিয়েটারে হয়ে এসেছে। তাকেই সোজাকথায় ‘ক্রসড্রেসিং’ বলা হয়। বিশ্বের সব দেশেই তার উদাহরণ নেহাত কম নেই। এমনকী সিনেমার আদিযুগেও তার নজির পাওয়া যাবে। ইদানীং অবশ্য এলজিবিটি-দেরও সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওই ধরনের সংস্থার সঙ্গে।‘ড্র্যাগ শো’ জনসংস্কৃতিরই একটা দিক। তার শিল্পীরাও লিঙ্গনির্দিষ্ট সাজ-পোশাক, কণ্ঠস্বর এবং হাবভাব বদলে তাঁদের অভিনয় করে থাকেন।  

 

ওই সংস্থার নামেই মিকোশিটির নামকরণ হয়েছে। শুরুর দিকে যথারীতি সাজ-পোশাক বদলে তার সদস্যরাই কাঁধ দিতেন। তবে ইদানীংকালে নাকি স্থানীয় মিকোশি সংস্থার সদস্যরা তা বয়ে নিয়ে যান। নারী-পুরুষ উভয়কেই নিয়মমতো সাজ-পোশাক বদলাতে হয়। ছেলেরা মেয়ে, আর মেয়েরা ছেলে সাজেন।

এর পরের মিকোশির নাম ‘কানামারা ওমিকোশি’। বর্গাকার বা চৌকোনা চালের এই মিকোশিটি সবচেয়ে পুরোনো। এর ভেতর থাকে দারুময় লিঙ্গরূপ। 

আরও পড়ুন
কাকড় আরতির সময় সমস্ত প্রক্রিয়া দর্শন করেই যেন টের পাওয়া গেল ‘দেবতার জন্ম’ কীভাবে হয়

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
এলিজাবেথ মিকোশি নিয়ে ট্রান্সজেনডার মেয়েদের যাত্রা

শোভাযাত্রার পুরোটাই যেহেতু জনবসতি এলাকার ভেতর দিয়ে হয়, তার দরুন উৎসুক লোকজনের ভিড়ও বেশি, থিকথিক করতে থাকে অগুনতি দর্শক। অপর্যাপ্ত মদ আর মাতালেরও কমতি নেই। নানাভাবে তাদের সাবধানও করা হয় সাধারণ বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগের জন্য।      

 

খবরে প্রকাশ, জনসংখ্যার হিসেবে জাপানে জন্মহার খুবই নীচে নামতে দেখে, উদ্‌বিগ্ন সরকার ‘চাইল্ড অ্যালোয়েন্স’ থেকে ‘স্পিড-ডেটিং’এর আয়োজন, সবরকমেই তৎপর হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই হচ্ছে সঠিক সময়, উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাচীন উৎসবের পুনরুত্থানের কথা ভাবলে, ‘কানামারা মাতসুরি’র তাৎপর্যও হয়তো ধরা পড়বে। 

  আরও পড়ুন
একসময় সোনার থেকেও মূল্যবান ছিল এই মশলা,উৎস লুকিয়ে রাখতে ফাঁদা হয়েছিল মিথ্যা গল্প!

কানামারা মাতসুরি: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বসন্তে আজ লিঙ্গরাজের উৎসবে
কানামারা ওমিকোশি ঘিরে জনতা

অবশ্য এর জনপ্রিয়তার কারণে নানারকম সমালোচনাও ক্রমশ বেড়েছে। টাকা কামানোর চমৎকার রাস্তা হয়ে উঠেছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। অন্তত এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্য, বা লক্ষ্য থেকে অনেকটাই সরে গেছে বলেই মনে করেন তাঁরা। আবার বিদেশি মুদ্রাও যে আসছে এই উৎসবের দরুন, সেদিকটাই-বা অবহেলা করে কোনজন! উপরন্তু এই উৎসব থেকেই তো এইডস-এর গবেষণার জন্য অর্থসংগ্রহ করা হয়। এও কি সদর্থক উদ্যোগ নয়? সমালোচনার পাশাপাশি এসব কথাও যেমন বলেন অনেকে।  

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থ-সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য বইগুলি: কবিতা : 'সমাচার দর্পণ', 'মায়াবন্দর', 'খণ্ডিত শ্লোকের দিনে', 'চন্দ্ররেখার সনেট', 'ছিন্ন ডুরি জোড় দিয়ে'। গদ্য: 'কলকাতার রঙ্গিণীকথা'। অনুবাদ : 'কবীর ও তাঁর কবিতা', 'কবীর-বীজক ও অন্যান্য কবিতা'। সম্মাননা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি-র লীলা রায় স্মারক পুরস্কার (২০০২), সাহিত্য অকাদেমি অনুবাদ পুরস্কার (২০০৫)

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!