৫ ডিসেম্বর, ২০২৩মঙ্গলবার

৫ ডিসেম্বর, ২০২৩মঙ্গলবার

অ্যানে ফ্রাঙ্কের চরিত্র দিয়ে যখন আমার অভিনয়জীবন শুরু করলাম সমালোচকরা লিখলেন আমিই অ্যানে

বছর সাতেক বয়েসে মেয়ে লিন তার বাবা ইংগমার বার্গম্যানের কাছ থেকে একটি সাইকেল পেয়েছিল। মেয়ের নতুন সাইকেল আর মায়ের পুরোনো সাইকেল দু-টি নিয়ে অনবদ্য এক আখ্যান বুনেছিলেন লিভ উলমান তাঁর আত্মকথার একাংশে। এ ছাড়াও আগের পর্বে ছিল তাঁর অভিনেত্রী হয়ে ওঠার সূচনাপর্বের দিনগুলোর কথা। স্বাধীন মানসিকতাই যাঁর অল্পবয়েস থেকে একা যাপনের সাহসও জুগিয়েছিল নিজের লক্ষ্যে পৌঁছোতে। দিন গুজরানের জন্য অতি সাধারণ কাজও করতে হয়েছে কখনো। নিজের অভিনেত্রী হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কোনোদিন কোনো সংশয় না থাকলেও, ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা অনিশ্চয়তার বোধও যে সক্রিয় ছিল, তা-ও বলেছেন। এবার নাটকের দলের সঙ্গে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে সফরের প্রসঙ্গ ছাড়াও, অভিনয়ের সূত্রেই কীভাবে পরিচিত হলেন রক্তের সম্পর্কে এক খুড়োদাদুর সঙ্গে, সে-কথাও বলেছেন। যেমন ঘুরে-ফিরে এসেছে মেয়ের কথা এবং মা হিসেবে নিজের ভূমিকাপালনে অসম্পূর্ণতার কথাও। স্মৃতির উজানে চলে গেছেন আবার নাট্যদলে যোগদানের প্রাথমিক পর্বে। শুরুতেই বিখ্যাত বালিকা অ্যানে ফ্রাঙ্কের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগে সুনামও পেয়েছিলেন যথেষ্ট। কবি-অনুবাদক সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর তরজমায় ভিন্নসময়-এর পাঠকদের জন্য রইল এবার সেইসব বৃত্তান্ত। গত তিন মাস ধরে যে-আত্মকথার নির্বাচিত অংশ প্রকাশ পেয়ে এসেছে, তারই শেষ পর্বে

 

গ্রুপ থিয়েটার

নাট্যসফরের বাসটা এসেছিল এক আশীর্বাদের মতো। কারোর কোনো দাবি নেই। ভিক্তর বোর্গে (১) একবার যা বলেছিলেন, মনে পড়ে যাচ্ছিল, মঞ্চের ওপর থাকাটাই তিনি সবচেয়ে পছন্দ করেন, সেখানে কোনো টেলিফোন আসে না।
পাশের জনের সঙ্গে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা প্রাণ খুলে আড্ডা মারি। স্বদেশের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় হয়। মাঝে মাঝে আমরা কেউ কেউ ভোরের দিকে শুরু করি হাঁটা। বাসটা যখন আমাদের ছাড়িয়ে যায়, ঘেমে, ফুর্তিতে টগবগ করি।

 

প্রতিদিন কোনো নতুন জায়গায় পৌঁছোনোর আশা, প্রতি সন্ধ্যায় নতুন করে নতুন দর্শকদের সামনে পাওয়ার আশা। থিয়েটারের অভিজ্ঞতা যাদের নেই, তেমন-সব লোকজনের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা। এখনও যারা দূরদূরান্ত থেকে সাইকেলে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে নাটক দেখতে আসাটা ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করে, সেইসব নারী-পুরুষের সামনে অভিনয় করা। অস্বস্তিকর বেঞ্চিওয়ালা ছোটো একটা হলঘরে ঠাসাঠাসি ভিড়। পুরোনো লজ্‌ঝড়ে একটা স্টেজ, আলোকসম্পাতের অবস্থাও সঙ্গিন।

 

আমরা হলাম গ্রুপ থিয়েটার। অদ্ভুত একটা হোটেলে খাওয়া-দাওয়া সেরেছি। ফোনে কথা বলেছি স্বামী বা স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে,তাৎক্ষণিক একটা সাজের টেবিল বানিয়ে নিয়েছি।
ওরা হল জনতা, যারা ওই অন্ধকারের ভেতর নিজেদের জীবনটা বাঁচে। ওদের সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতায় থেকে যায় ওদের শ্বাস-প্রশ্বাস, ওদের হাসি, ওদের নড়াচড়া। হঠাৎ করে কখন একটা তারে ঘা পড়ে, আমরা এক হয়ে যাই। প্রেক্ষাগৃহ স্থির, মঞ্চ সচল।

আরও পড়ুন
মনে আছে, তখন প্রথম কয়েক মাস নিঃসঙ্গতাই ছিল আমার সঙ্গী

লিভ উলমান

ভোররাতে হোটেলে আমাদের কয়েক জনের জন্যে রয়েছে ওয়াইন আর মোমবাতি। পরের দিন আবার পাড়ি আরেক জায়গায়। পোশাক-আশাক, দৃশ্যপট আর সুটকেসভর্তি একটা বাস। আর ক-জন লোক, যারা ক-দিনের জন্যে একসঙ্গে রয়েছে।

 

বড়ো বড়ো নাট্যকোম্পানিগুলো যাদের পাশ কাটিয়ে যায়, তেমন-সব ছোটো গ্রামাঞ্চলে ঘুরি আমরা। ভরাভর্তি হলঘরে অভিনয় করি। মাঝে মাঝে লোকেরা আশপাশের বাড়ি থেকে বাড়তি চেয়ার নিয়ে আসে।
সেলিয়োর্দে আমার ঠাকুরদার বাবার মূর্তি রয়েছে। রাস্তার ধারেই বসানো সেটা। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গর্ব হয়। উনি এখানে একটা নতুন স্কুল চালু করেছিলেন, নরওয়েতে ওই ধরনের স্কুল সেই প্রথম। এইসব এলাকায় আমার চেয়ে ওঁর পরিচিতিই বেশি।

 

অসলোতে একবার ওঁর এক ভাইপোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
তখন আমার বয়েস অল্প, নববিবাহিত, কাজ করছি এখন যে-নাট্যদলে, সেখানেই। তিনি ছিলেন ছোটোখাটো ক্ষয়াটে চেহারার বছর পঁচাত্তরের এক ভদ্রলোক, সরকারি মহাফেজখানার অধ্যক্ষ। আমার মতোই তাঁর সম্পর্কেও আত্মীয়স্বজনরা ছিল নির্লিপ্ত।
এক সন্ধেয় স্টেজের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনি জানালেন, সম্পর্কে তিনি আমার খুড়োদাদু। সামনের সপ্তাহে তাঁর সঙ্গে ডিনারে গিয়ে আমি কি তাঁকে বাধিত করতে পারি? স্বভাবতই আমার স্বামীও আমন্ত্রিত। আমরা ভ্যালকাইরি রেস্টোর্যাকন্টে দেখা করব ঠিক করলাম।
সাজগোজের ধার ধারলাম না। পরে যাতে এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে পারি, তাই জোরজার করে স্বামীকেও যেতে রাজি করালাম।

আরও পড়ুন
আমরা যারা নরওয়ে থেকে এসেছি এই প্রথম টেলিভিশন দেখলাম

লিভ উলমান

হেডওয়েটার সাড়ম্বর অভ্যর্থনা জানাল আমাদের। পুরোনো সেই রেস্টোর‍্যান্টে হঠাৎই যেন আভিজাত্য দেখা দিল। আগে মনে হত ওখানে কেবল বিয়ার আর মাংসের বড়া খাওয়া হয়। সযত্নে আমাদের কোট খুলে নেওয়া হল। ক্লোকরুমের বেয়ারাটি মৃদুকণ্ঠে জানাল, মিস্টার উলমান ওপরের তলায় অপেক্ষা করছেন। তার গলায় সম্ভ্রম ঝরে পড়ছিল। খুড়োদাদু খ্যাতনামা, অবশ্যই এমন হেঁজিপেজি কেউ নন যাঁর সঙ্গে দেখা করে দুই তরুণ-তরুণী নিজেদের ধারণামতো তাঁকে ‘বাধিত’ করতে পারে।

 

ফুল দিয়ে টেবিল সাজানো। আমাকে একটা গোলাপ আর আমার স্বামীকে বাটনহোলে লাগানোর জন্যে একটা কারনেশন দেওয়া হল।
বুড়োমানুষটি পুরোনো কালো সুট পরেছিলেন। যেটুকু চুল অবশিষ্ট ছিল, তা সযত্নে আঁচড়ে চাঁদিতে বিন্যস্ত। সন্ত্রস্তভাবে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে করমর্দনের সময় দেখলাম তাঁর হাত একেবারে ঠান্ডা।
আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সন্ধেগুলোর মধ্যে সেটা ছিল একটা।

 

খাদ্যতালিকা থেকে শুরু করে কথাবার্তা— সবই ছিল সুনির্বাচিত। আর মজা করব বলে এই জিন্‌স পরে চলে আসার জন্যে লজ্জা পাওয়াটা বন্ধ হতেই আমি পিতৃকুলের এত কাছাকাছি চলে গেলাম, যেমন আগে কখনো যাইনি।
প্রতিটি পদের সঙ্গে ছিল ছোটো এক-একটি ভাষণ, বংশগৌরব সম্পর্কে উৎসাহব্যঞ্জক সব কথা। ডেসার্টে পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমরা তিন জনই যারপরনেই আবেগস্পৃষ্ট হয়ে পানীয়ের গ্লাস তুলে ধরলাম।
উনি আমার নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন। আমায় দিলেন ওঁর পুরোনো ঢঙের চিত্রিত লিপি দিয়ে লেখা এক বংশলতিকা।

আরও পড়ুন
ঠাকুমা আমায় দেখতে শিখিয়েছিল একটা পাতার শিরা কেমন দপদপ করা জীবন্ত

ছবির সেটে কন্যা লিন-সহ লিভ উলমান ও ইংগমার বার্গম্যান

তারপর যেমন মর্যাদাপূর্ণভাবে আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, তেমনিভাবেই ইঙ্গিত করা হল, ডিনার শেষ হয়েছে।
খুড়োদাদু সব কিছুই খুব উপভোগ করছিলেন, কিন্তু বয়েস হয়েছে, ওঁর এখন বিশ্রাম দরকার।
শীর্ণ হাতটা আমার হাতের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল। দ্রুত একবার আলিঙ্গন করলাম ওঁকে। উনি একটু যেন অপ্রস্তুতভাবে গলাখাঁকারি দিলেন।

 

দু-তিন বার ফুল পাঠিয়েছিলাম, একটা চিঠিও। কিন্তু এত ব্যস্ত ছিলাম যে, বাড়িতে ডাকাটা সমানে পিছিয়ে দিতে হচ্ছিল।
একবার দেখেছিলাম ফুটপাথ ধরে আমার দিকেই হেঁটে আসছেন। কী বলব ভেবে না-পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি রাস্তার ওপারে চলে গেলাম। তক্ষুনি আবার তাঁকে যে কত পছন্দ করি তা জানানোর জন্যে দৌড়ে ফিরে এলাম। ভয়ও করছিল, উনি হয়তো আমায় দেখে ফেলেছেন। কিন্তু তাঁকে আর খুঁজে পেলাম না। কিছুদিন পরে কাগজে দেখলাম উনি মারা গেছেন। শেষকাজে আমি যাইনি। সেদিন আর পরিবারের বাকি লোকেদের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করেনি।
—————-
(১)ভিক্তর বোর্গে (১৯০৯-২০০০): ড্যানিশ-আমেরিকান কৌতুকশিল্পী, পিয়ানোবাদক ও সংগীত পরিচালক। ইউরোপ-আমেরিকায় রেডিয়ো- টেলিভিশনের জগতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন।

 

ব্যর্থ এক মা

টেলিফোনে লিনের গলা। সুদূর, চাপা। ওকে বোঝাতে হয় আমার ভালোবাসা— ‘ছোট্ট মা, সবচেয়ে তোকেই তো ভালোবাসি!’
–‘না, বাসো না।’
মেয়েটার গলা বুকে কেটে বসে।
আমি এখনও সেই নাট্যসফরের বাসে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছি নরওয়ের প্রত্যন্ত কোনো জায়গায়। সারাক্ষণ কোথাও-না-কোথাও চলেছি। বাড়িতে থাকছি খুব কম। দেখতে পাচ্ছি আমার কোলের, আমার হাতের যা করার কথা ছিল,তা করছে আয়া আর প্রতিবেশিনীরা। তারাই জড়িয়ে রয়েছে আমার মেয়েকে। ওরা লুকোনোর চেষ্টা করলেও আমি বুঝতে পারছি লিনের প্রতি ওদের করুণা। আর লিনও সম্ভবত টের পাচ্ছে সেটা।

 

বুঝতে পারছি, ওদের কাছে আমার পেশা আর তাতে সাফল্য আসলে ব্যর্থতারই নামান্তর, কারণ বাড়িতে আমি আমার ভূমিকা পালন করছি না, যেটা তারাকরে দিচ্ছে। আমার সম্পর্কে ওদের সমালোচনাগুলো মেনে নিই। ওরাও তো আমার আপনজন।

বাসে লোকজনের মধ্যে বসে আমার ভয় করে পাছে আমার মেয়েটাও আমার একাকিত্বের ভাগিদার হয়ে পড়ে। এই একাকিত্বকে আমি কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু ও হয়তো এমন কোনো সম্পর্ক চায়, যা আমার কাছে পায় না।
নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে, যখন আমি আমার নিজস্ব পৃথিবীতে একা ছিলাম। অবাক হয়ে দেখতাম বড়োদের জীবন, তাদের কাজকর্ম। তারা যা যা করত, সবই মনে হত খুব জরুরি, কেননা কোনো মানে বুঝতাম না সেসবের, আর তারা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত। ছোটোরা সেইসমস্ত কিছুর বাইরে থেকে যায়। মনে হয় না, বড়োদের সেই জগতে তাদের কোনো জায়গা আছে।

আরও পড়ুন
প্রথম ছবি ‘ইয়ং এসকেপ’এর প্রিমিয়ারে আমার এক খুড়োদাদু পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে জানতে চান ওই সিনেমার শো বন্ধ করা যায় কি না

লিভ উলমান

বাড়ি ফিরে অনেক কিছু দেব লিনকে। নিয়ে যাব নাটক আর সিনেমায়। মা কীরকম একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল, সেই গল্প শোনাব কোলে বসিয়ে। নাটক নিয়ে এই ঘুরে বেড়ানো শেষ হয়ে গেলেই ওইসব কিছু করব। করব টেলিফোন বেজে ওঠার আগে, আমার ওপর অন্যদের দাবি ওর চেয়ে বেশি হয়ে পড়ার আগেই।

 

একসঙ্গে কাটাব দিনগুলো। কিন্তু তারপরই ক্রমশ আমার বিবেক তাড়া দিতে শুরু করবে— উত্তর না-দেওয়া যত চিঠি, পড়ে-থাকা যত কাজ। আর ক্রমশ আবার আমি হয়ে উঠব একজন পেশাদার মহিলা। আর গিয়ে দাঁড়াব কোনো মঞ্চের ওপর, কোনো ক্যামেরার সামনে, কোনো মিটিঙে। আর ভেবে যাব বাড়িতে পড়ে-থাকা ওর কথা, যার জীবনে আমি সমানে ব্যর্থ হয়ে চলেছি, কারণ ওর শৈশব আর আমার এই পরিণত নারীজীবনকে কী করে মেলানো যায়, তার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।
বইয়ের চরিত্ররা যেমন পেরে যায়,অন্য মহিলারা যেমন পেরে যায় তাদের সংসারে।

 

যখন নাটক

‘আমার ভেতর একটা বাচ্চা মেয়ে আছে, যে মরতে চায় না…’

থিয়েটার স্কুল তাকে চায়নি। কিন্তু ছোটো একটা মফস্‌সলি নাটকের দলের তার বয়েসি একজনকে দরকার ছিল।
সেই বিশেষ দিনটা চলে এল। অসলো স্টেশন থেকে একটা ট্রেন ছেড়ে দিল স্ট্যাভেঞ্জারের দিকে। সে তখন আঠেরো। আনন্দে ঝলমল করছে— এতদিনে হতে চলেছে সেটা! তার হাতব্যাগে যত্ন করে ভাঁজ করা রয়েছে কন্ট্র্যাকটের কাগজটা, বার বার খুলে আর ভাঁজ করে মুগ্ধ হয়ে নিরীক্ষণ করার ফলে এরমধ্যেই মলিন। যারা সেটা দেখতে চেয়েছে আর যারা মোটেই চায়নি, সকলকেই সেটা দেখানো হয়ে গেছে।

 

মাইনে বছরে ছ-শো ডলার আর আনন্দ লাখ টাকার। তাকে প্রথম চরিত্র দেওয়া হল অ্যানে ফ্রাঙ্কের। পৃথিবীজোড়া হাজার হাজার মেয়ের মতো তাকেও বাঁচতে হবে অ্যানের ভাবনায়, অ্যানের নিয়তিতে। আশা করতে হবে তার মতো। তার মতোই বিশ্বাস রাখতে হবে।
যারা যারা অ্যানে ফ্রাঙ্কের চরিত্রে অভিনয় করেছে, তাদের মতোই সে-ও অচিরে সাফল্য পেয়ে গেল। সেই ছোট্ট ইহুদি মেয়েটার জ্বলজ্বলে সারল্যের মধ্যে সে যেন নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছিল, তার নিজের সেই স্বপ্ন যে, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হল ভালোবাসা— অর্থহীন এই পৃথিবীকে পেরিয়ে যা অমরত্বের দিকে চলে যায়।

আরও পড়ুন
কোথায় যেন পড়েছিল কোনো বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের পক্ষে যৌন অভিজ্ঞতা না-থাকাটা ক্ষতিকর

অ্যানে ফ্রাঙ্কের ডায়ারির পৃষ্ঠা

গোলাপ আর পত্রগুচ্ছ, সাক্ষাৎকার আর হঠাৎ-পাওয়া খ্যাতি। বিশেষ কোনো চেষ্টা ছাড়াই যে হয়ে উঠল এমন একজন, যাকে সবাই চিনতে পারে। হয়ে উঠল নাটকের লোক, নিজের পরিচয় দিতে পারল অভিনেত্রী হিসেবে, যদিও আসলে সে ছিল এক শিক্ষানবিশ মাত্র।

 

এই আশাই তো তার ছিল যে, সব কিছু এইভাবেই ঘটবে। একবার যদি সে মঞ্চে জায়গা পায়, তার ক্ষমতা আর লুকিয়ে থাকবে না ছায়ার আড়ালে, স্বপ্নের ভেতর। আগের ব্যর্থতাগুলোর কোনো গুরুত্বই যে নেই, তার প্রমাণ হিসেবে সে ব্যগ্র হয়ে থাকত প্রশংসার জন্যে। জনতার ভালোবাসা তাকে পেতেই হবে, আর যদি সে তাতে ঠিকমতো সাড়া দিতে পারে, দিতে পারে মেধার পরিচয়, সে-ভালোবাসা থেকে যাবে পর্দা পড়ে যাওয়ার পরেও। জনতা যাতে তাকে মেক-আপ তুলে ফেলার পরেও পছন্দ করে, সেই ইচ্ছের আগুন তার মধ্যে জ্বলতে লাগল। যত বেশি লোক তাকে নারী হিসেবে গুরুত্ব দেবে, যত সে পূরণ করতে পারবে তাদের প্রত্যাশা, ততই তার যোগ্যতা প্রমাণিত হবে। বহিরঙ্গে কোনো দাগ থাকা চলবে না। সকলকে খুশি করার জন্যে সে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠল। ভুলে গেল সে একা ছিল, অনিশ্চয়তায় ভরা। ভুলে গেল মঞ্চের পেছনে আরেকটা পৃথিবী রয়েছে।

আরও পড়ুন
আমি ছুটছি আরেক জগতের দিকে, যাকে আমি সবসময় স্বীকার করি না

অ্যানে ফ্রাঙ্কের ডায়ারির পৃষ্ঠা

অ্যানে ফ্রাঙ্কের চরিত্র দিয়ে যখন আমার অভিনয়জীবন শুরু করলাম, সমালোচকরা লিখলেন, আমিই অ্যানে। মনে করিনি যে এর অর্থ আমার জীবন বা অভিনয়-বিশ্লেষণ বা চেহারা ওই ডায়েরির নায়িকার মতো। আসলে মঞ্চের ওপর দু-ঘণ্টা আমি বাস করতাম অ্যানের আত্মায়। অ্যানেই অভিনয় করত অ্যানের চরিত্রে। অনেক অনেক বছর পঅরে আবার স্বাদ পেয়েছিলাম ওইরকম পূর্ণ একাত্মতার।

 

আমার অভিনয় কোনো ভান নয়, বাস্তব ছিল। জানতাম ওটা নাটক, কিন্তু নাটকের বাস্তব। ছোটোবেলায় যেমন এক ফ্যান্টাসির সঙ্গে জড়ানো আমার ইচ্ছে-অনুভূতিগুলো ছিল বাস্তবেরই। রেগে যেতাম, যখন কেউ বলত আমার ‘নাটকের চরিত্র’।

‘না, আমি অভিনয় করছি না, বানাচ্ছি না কিছু।’
মনে হতে লাগল, আমি যা খুঁজছিলাম, স্ট্যাভেঞ্জারের চারদেওয়ালের মধ্যে তা পেয়ে গেছি।
সকালে তাড়াতাড়ি চলে আসতাম। ওই আধো-অন্ধকার, ওই ধুলোভর্তি জায়গা, দম-বন্ধ-করা সাজঘর, পুরনো এবড়োখেবড়ো পাটাতনের স্টেজ— এই সব কিছুই ছিল আমার নিজের জগৎ, পৃথিবীর মধ্যে যেখানটায় সবচেয়ে বেশি করে থাকতে চাইতাম।

 

ঘড়ির দিকে না-তাকিয়ে রিহার্সাল বা আলোচনা। পর্দা ওঠার আগে প্রেক্ষাগৃহের গুঞ্জন। আর্কলাইট। উত্তেজনা। দর্শকরা। স্নায়ুর চাপ। চরিত্র যা নিজের জায়গা নিজেই করে নেয়। চরিত্রের সঙ্গে কাঁদা। এক কাল্পনিক মানুষের কাছ থেকে ধারকরা হাসি, কামনা রাগ। নিজের জীবনে প্রায় না-জানা সব অনুভব। সহ-অভিনেতার তাকানো, অভিব্যক্তি, অঙ্গভঙ্গি। মাঝে মাঝে এতটাই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য যেন নাটকের বাইরের অন্যসব সম্পর্ককেই অবাস্তব বলে মনে হওয়া। আটটা থেকে সাড়ে-দশটা পর্যন্ত প্রতি সন্ধেবেলা মঞ্চের ওপর স্পন্দমান তীব্র অনুভূতিগুলোর চেয়ে কোনো ভালোবাসা, কোনো ঘৃণাই বড়ো হয়ে উঠতে পারত না।

আরও পড়ুন
তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা

লিভ উলমান

বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই নিজের পেশার সঙ্গে নিজেকে এরকম সম্পূর্ণভাবে মিশিয়ে ফেলাটা ফুরিয়ে যায় কয়েক বছরের মধ্যে।
কিন্তু অল্প কয়েকজন থাকে, যারা কোনোদিনই মঞ্চের বাইরের জীবনে ফিরতে পারে না। তাদের বয়েস বাড়ে, অন্যদের ওপর ভর দেয় আর ১৯৩০ সালে যে-সংলাপ বলেছিল, তা-ই আওড়াতে থাকে। লোকের সামনে বসে থাকে হ্যামলেট বা রাজা লিয়ার, আর লোকে আড়ষ্ট হয়ে থাকে এই ভয়ে, পাছে তাদের কোনো অসতর্ক মন্তব্যে মানুষটা তার পুরো পেশাদার জীবনব্যাপী মনোরম এক স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে।
পুরো জীবনের চেয়েও যা বেশি।

(সমাপ্ত)

সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি ও অনুবাদক। অবসরপ্রাপ্ত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: অবিদ্যা, বসন্তপ্রকৃতি, আরব্য উপন্যাসের মেয়ে বা মেয়েদের ব্রতকথা, ঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকা, নীলবেগুনি শরীরের দেবী, কাজলরেখার বাড়ি প্রভৃতি। সম্মাননা: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক পুরস্কার (১৯৯৬), কৃত্তিবাস পুরস্কার (২০০১), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির অনীতা-সুনীলকুমার বসু স্মারক পুরস্কার (২০০১), রবীন্দ্র পুরস্কার (২০১৮)।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!