২০ এপ্রিল, ২০২৪শনিবার

২০ এপ্রিল, ২০২৪শনিবার

তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা

আগের পর্বে প্রথম মঞ্চাভিনয় আর সিনেমা দেখার শৈশবস্মৃতির পাশাপাশি বলেছিলেন ছোটোবেলার অজানা এক ভয়ের কথাও। আবার মঞ্চ আর রুপোলি পর্দায় ব্যস্ত কাজের জগতের প্রসঙ্গও এসেছিল। সর্বোপরি ছিল নিজের লেখালেখি, সাংসারিক জীবন নিয়েও গভীর উচ্চারণ। এবারেও লিভ উলমান ফিরে তাকিয়েছেন শৈশবের দিকে। তাঁর কথামতো ছিলেন ‘ছোটোখাটো, রোগাটে, বেশ আত্মকেন্দ্রিক আর দিবাস্বপ্নে ডুবে-থাকা’, ‘ভালো রেজাল্ট আর অসম্ভব একঘেয়েমিতে ভরা’ এক মেয়ে। এসেছে স্কুলজীবনের একাধিক প্রসঙ্গ। সেখানে স্কুল-কামাইয়ের ফিকির খোঁজার কথাও যেমন আছে, তেমনি আবার বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকার আচরণের প্রসঙ্গও। এমনকী কখনো শিল্পী, কখনো আবার লেখক-সাংবাদিক, কি কখনো অবলা জীবপ্রেমী ছাড়াও সর্বোপরি অভিনেত্রী হতে চাওয়ার পাশাপাশি মেয়েবেলার নিজস্ব গোপনকথাও। কবি-অনুবাদক সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর তরজমায় ভিন্নসময়-এর পাঠকদের জন্য সেইসবই উপস্থিত এবার পঞ্চম পর্যায়ে

 

ইস্কুলের ভালোমন্দ

কী কী বিষয় ছিল, কী পাঠ্য— সবটাই প্রায় ভুলে গেছি। ভবিষ্যৎজীবনে যেসব জিনিস আমার কাজে লাগবে না বলে তখনই বুঝতে পারতাম, সেসব চাপা পড়ে আছে স্মৃতিকুঠুরির এককোণে। নষ্ট-হওয়া সময়, যা-কিছু ভুল, সমস্ত বোকামি— সব একটা দলা পাকিয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে সেটা দেখি, অনুভব করি।
তার চেয়ে বরং চোখে-ধরে-রাখা ছবিগুলো মনে করা সহজ। ক্লাসের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা খয়েরি সব পয়েন্টার-শোয়ানো, শিক্ষিকাদের নানান গড়ন আর আকারের ভয়-পাওয়ানো ডেস্কগুলোর রং। হাতে নিলেই ভেঙে যাওয়া, আর নয়তো ব্ল্যাকবোর্ডের ওপরে বিচ্ছিরি ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করা চক।
সেলাই ক্লাসে আমরা যেসব উলের দস্তানা তৈরি করতাম, জিমের প্যান্ট আর স্কুলের অ্যাপ্রন, আমার ঘেমে-ওঠা অনিচ্ছুক আঙুলগুলোর মধ্যে সেসব ক্রমশই ময়লা থেকে আরও ময়লা হয়ে উঠত। নদী, সীমারেখা আর যত পর্বতমালার অনন্ত একঘেয়ে নাম প্রাণপণে মুখস্থ করে একদিন আওড়াতাম, পরের দিনই সব ভুলে যেতাম।

আরও পড়ুন
একটা বই লেখার চেষ্টা মাত্র আমার সাংসারিক দায়িত্বপালনের অক্ষমতাকে পুষিয়ে দেয় না

তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা
লিভ উলমান

রান্নার ক্লাস। স্টোভ পরিষ্কার করা, ব্ল্যাক পুডিং তৈরি করার জন্য গরম রক্ত জমানো আর মেঝে মোছা। এমন রাগি এক শিক্ষিকা, তাঁর হাত থেকে বাঁচার জন্যে পায়ের ওপর ফুটন্ত জল ফেলে হাসপাতাল-ঘরে চলে যাওয়াটাই ভালো মনে হত। সারাক্ষণ শাসন, ‘ওরকমভাবে হাতের ওপর মাথা রেখে তুমি কিছুই ভেবে উঠতে পারবে না’ (বড়ো হয়ে চিরকালই আমি হাতে মাথা রেখে ভেবে এসেছি); ‘পায়ের ওপর পা তুলে বসলে শেষকালে খোঁড়াবে’ (বড়ো হয়ে আমি একটার সঙ্গে অন্য পা-টাকে পেঁচিয়ে বসি)।
শেষপর্যন্ত স্কুলটার ওপর আমি এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলাম যে, কামাই করতে শুরু করলাম। বাড়িতে থেকেই ভাবতাম, মাকে বোঝাতে পেরেছি আমার পেটব্যথা বা সর্দিকাশি সত্যিই হয়েছে। অবশেষে একদিন মা আমার শোয়ার ঘরে একজন শিশু মনোবিদ আর এক নার্স-সহ আবির্ভূত হলেন। আবহে মায়ের কান্না, নার্স জামাকাপড় পরাতে লাগলেন আর মনোবিদটি ধীরগলায় নানা আবোলতাবোল বকতে বকতে আমায় নিয়ে চললেন হাসপাতালে।
সেখানে মস্ত একটা ওয়ার্ডে সত্যিকারের অসুস্থ সব বাচ্চাদের হার্টের দোষ, ব্রেন অপারেশন আর একটা ছোট্টো বাচ্চার চ্যাঁচানির মধ্যে আমি প্রদর্শিত হতে লাগলাম স্কুল-পালানো মেয়ের উদাহরণ হিসেবে। আমার গোলাপি-গাল সুস্বাস্থ্যের দিকে নার্সদের অনুকম্পাভরা চাউনির তাড়নায় একদিন আমি হাসপাতালের পাজামা পরেই জানলা দিয়ে লাফিয়ে নেমে বাগানে ছুটোছুটি করতে লাগলাম, জড়িয়ে ধরলাম সাদা কোট-পরা চিন্তামগ্ন একজন ডাক্তারকে, তারপর জলভরা চোখে জানতে চাইলাম তিনি আবার বাবা কি না। এই চিত্তবিচলনকারী কার্যকলাপ অবিলম্বেই ফলপ্রসূ হল। আমাকে রাখা হল একটা একা-ঘরে, মনে করা হতে লাগল আমি সত্যিই অসুস্থ। ক্লাসসুদ্ধু সবাই আমায় চিঠি পাঠাতে শুরু করল, উদ্‌বিগ্ন চোখে মা খাটের পাশে বসে রইল আর সেই মনোবিদটি আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগলেন এই সবই যে আমার ভালোর জন্যে করা হচ্ছে, তা আমি বুঝতে পারছি কি না। এই যে স্কুল, গোটা স্কুলই, আমার অভাববোধ করছে, মায়ের মনখারাপ হচ্ছে, দিদির মনখারাপ হচ্ছে, আর আমি কি বুঝতেই পারছি না যে আমি সবাইকেই ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছি? যখন বললাম,হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি, তিনি মাকে জানালেন, আমায় তিনি সুস্থ করে দিয়েছেন আর আমায় জানালেন, এবার আমি বাড়ি ফিরতে পারি, ফিরে যেন মায়ের কথা শুনে চলি আর স্কুলে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশুনো করি। ওঁর হাত ধরে আমি সুন্দরভাবে কার্টসি করলাম, আর খুব নরম গলায় ধন্যবাদ দিলাম আমায় ভালো করে তুলতে এতকিছু করার জন্যে। বিশেষ করে না বলে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে আমায় ঠেলে হাসপাতালে চালান করার কারণে।
তারপর ঠিক করলাম, শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা। এমন একটা বই লিখব যে, গোটা পৃথিবী চমকে যাবে। সে হবে ভারি দুঃখের এক কাহিনি,আর সবাই অবাক হয়ে ভাববে এত ছোটো একটা মেয়ে কী করে এমন জ্ঞানগর্ভ বিষাদময় বই লিখতে পারে।

আরও পড়ুন
যদি ছবিটা ভালো চলে, বাড়ি তৈরির টাকাটা দিতে পারবেন, নিজের টেনিস-কোর্ট হবে, পরের ছবি করা সম্ভব হবে

তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা
(বাঁ-দিক থেকে) ইংগমার বার্গম্যান, ইংগ্রিড বার্গম্যান, লিভ উলমান।

আমার প্রাথমিক স্কুলের একজন আর হাইস্কুলের একজন, এই দু-জন শিক্ষকের কথা মনে পড়লে এত আনন্দ হয়! হ্যাঁ, আরও অনেকেই ছিলেন, কিন্তু ওই দু-জনের সঙ্গে ছিল আমার নিবিড় আর নিরুচ্চার সম্পর্ক। প্রথম জন আমার একটা রচনার নীচে লিখেছিলেন, ‘প্রিয় লিভ, তোমার কল্পনাশক্তি আর প্রকাশ করার ক্ষমতা খুবই ভালো। কিন্তু মাঝে মাঝে তুমি জলের এত গভীরে তলিয়ে যাও যে, সেখান থেকে উঠে আসতে গেলে অনেকটা সাঁতার কাটতে হয়। এটাও অবশ্য একটা ছবি। প্রিয় লিভ, তুমি কি বুঝতে পারছ, আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি?’ ছোট্টো লিভ বুঝতে পেরেছি্ল, আর বড়ো হওয়া অবধি সেই চিঠি রেখে দিয়েছিল নিজের কাছে।
রক্তিম গাল আর কালো ফ্রেমের চশমা-পরা আরেক জন শিক্ষক ছিলেন। তাঁকে ছাড়া হাইস্কুলের দিনগুলো আমার অত্যন্ত নোংরা স্কুল-অ্যাপ্রনের মতোই অর্থহীন হতে পারত।
আমি ছিলাম ছোটোখাটো, রোগাটে, বেশ আত্মকেন্দ্রিক আর দিবাস্বপ্নে ডুবে-থাকা। ভালো রেজাল্ট আর অসম্ভব একঘেয়েমিতে ভরা। হাতখরচের টাকা দিয়ে কেনা লুকোনো একটা ব্রায়ের মধ্যে মায়ের দস্তানা পুরে তৈরি করা কৃত্রিম স্তন। জিম ক্লাসে নাম ডাকার সময় মেয়েরা মাসে একবার করে অভিজ্ঞ গলায় ‘ওই ওটার জন্য’ বলে ছাড় পেয়ে যেত। আমার তেমন কিছু হত না। তবু ভান করতাম যে, হয়েছে, কিন্তু দিনের হিসেব রাখতে পারতাম না। পুরো একটা বছর এই ঠকানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলাম কিছু না বুঝেই, অথচ সব মেয়েরাই তখন বুঝত পারত। শুধু শিক্ষিকারাই তাদের চুপ করিয়ে রাখতেন আর ভাব দেখাতেন যেন কিছুই বোঝেননি।
‘ওই ওটা’, কী আশ্চর্য কথা, যাদের তা ঘটেছে, তাদের আলাদা করে রাখত বাকিদের থেকে। শেষপর্যন্ত সেই দিনটা এল। আনন্দ আর ধরছিল না। আর কষ্টও। সেইসব সৌভাগ্যবতী মেয়েরা, যাদের প্রথম রক্তের দাগ তাদের সরলতার জগৎ থেকে অভিজ্ঞতার জগতে নিয়ে যায়, সেই জগতে— যা ক্রমশ তাদের কাছে আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন
হ্যামকে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি, আমিই নোরা, সানসেট বুলেভার্দে টারানটেলা নাচ নেচে চলেছি

তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা
ফেদেরিকো ফেলিনি(বাঁ-দিকে) ও ইংগমার বার্গম্যানের (মাঝে) সঙ্গে লিভ উলমান

মেয়েটা তখন তার জমানো টাকা দিয়ে ছবি আঁকার জিনিস কিনত— ইজেল আর রোমাঞ্চকর সব তেলরঙের টিউব। বান্ধবীদের রোমান্টিক প্রেমের কথায় তার একটুও হিংসে হত না। কারণ সে তো পরে বিশ্ববিখ্যাত এক শিল্পী হবে।
কিছুদিন পরে এল সাংবাদিকতা। সে পত্রিকা বার করতে লাগল। লিখতে শুরু করল নাটক আর কবিতা। একটা সময় তার আবার পশুচিকিৎসক হবার শখ হল। রাস্তার কুকুর আর বেড়ালে ভর্তি মস্ত একটা বাড়ি থাকবে তার। তারা মস্ত মস্ত সিল্কের কুশনে শোবে।
আর শেষপর্যন্ত, সবচেয়ে বেশি করে সে হতে চাইল অভিনেত্রী।

মাঝে মাঝে অবশ্যই আমি ক্লাসে সর্দার হয়ে উঠতাম। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে নিজেকে ‘বহিরাগত’ মনে হওয়া, সকলের চেয়ে আলাদা হওয়ার বোধ।
সেটাই যেন আমার গভীরে গেঁথে গিয়েছিল— একাকিত্বের সেই যন্তণাদায়ক অভিজ্ঞতা।
রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে বসার ঘর থেকে ভেসে-আসা বড়োদের হাসি-গল্পের আওয়াজ শুনে ভাবতাম বড়ো হলে ওই আশ্চর্য সব কথা আর হাসির অংশীদার হতে পারব।

আরও পড়ুন
যত বছর ধরে আমার কাজের জন্য লড়াই, খোঁজার চেষ্টা করেছি আমি কে, আমি কেন

তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা
শুটিঙের অবসরে খুশমেজাজে ইংগমার বার্গম্যান ও লিভ উলমান

শৈশবের সেসব অভিজ্ঞতার কতটা সত্যি ছিল, তা অবশ্য বলা মুশকিল— আমরা বয়স্করা তো উদ্ভট কল্পনাই বলি তাদের। কিন্তু কোনো শিশুর কাছে তা কল্পনা মাত্র নয়। তাকে ফেলে চলে যাওয়ার ভয়, দুষ্টু নেকড়ে, আলমারির ভেতরকার অন্ধকার— সবটুকুই সত্যি। অন্যরা তাকে অন্য কোনো নাম দেয় আলাদা করে চেনানোর জন্যে।
সত্যিটাকে আমরা বলি আজগুবি— আর সেটাই হল সবচেয়ে আশ্চর্য।

(পরবর্তী অংশ আগামী শনিবার)

সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি ও অনুবাদক। অবসরপ্রাপ্ত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: অবিদ্যা, বসন্তপ্রকৃতি, আরব্য উপন্যাসের মেয়ে বা মেয়েদের ব্রতকথা, ঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকা, নীলবেগুনি শরীরের দেবী, কাজলরেখার বাড়ি প্রভৃতি। সম্মাননা: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক পুরস্কার (১৯৯৬), কৃত্তিবাস পুরস্কার (২০০১), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির অনীতা-সুনীলকুমার বসু স্মারক পুরস্কার (২০০১), রবীন্দ্র পুরস্কার (২০১৮)।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!