৩ জুন, ২০২৩শনিবার

৩ জুন, ২০২৩শনিবার

সংস্কৃতের বদলে মারাঠিতে ভাগবতভাষ্য লেখায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে অপদস্থ হয়েছিলেন একনাথ

সন্তদের যাপনের ফসল তাঁদের বচনগুলি কীভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী স্বর হয়ে উঠেছিল, সেইটিই পরখ করে দেখা হয়েছিল আগের ক-টি পর্বে। সাওতা মালীর রচনা ছাড়াও নামদেবের রচনাও যেমন সহায়ক ছিল, তেমনি আবার সন্ত তুকারামের জীবনে ব্রাহ্মণদের শত্রুতার একাধিক ঘটনার উল্লেখও করা হয়েছে আলোচনাক্রমে। সন্ত একনাথের ‘ভারুড়’এর কথাও এসেছে, যেখানে ভাগবতধর্মী ভক্ত মহার হয়ে উঠেছে ব্রাহ্মণের প্রকৃত শিক্ষক। এবার সেই সন্ত একনাথ প্রসঙ্গেই বিস্তার। বাঙালি পাঠকের অনেক অজানা বিষয়ই সন্তজনের মুক্তধারায় ধারাবাহিকে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে চলেছেন, এবার ত্রয়োদশ পর্বেও তা যথারীতি পাওয়া যাবে।

 

কেবল যে অব্রাহ্মণ, বা শূদ্র কি অতিশূদ্ররাই ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন সেকালে, এমন নয়। ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও আবার অপদস্থ হয়েছিলেন সন্ত একনাথ (১৫৩৩-৯৯)।
নিজের ভজনপূজন আর বারকরী মানুষজনকে নিয়ে নিত্য কীর্তনের পাশাপাশি চলত একনাথের রচনাকর্ম। ১৫৫৫ সাল নাগাদ ‘চতুঃশ্লোকী ভাগবত’ (ভাগবতপুরাণের দ্বিতীয় স্কন্ধের নবম অধ্যায়ের ভাষ্য) রচনা করে গুরু জনার্দন স্বামীর কাছে পরীক্ষা একরকম হয়ে গিয়েছিল। তার বছর চোদ্দো পর, ১৫৭০ সাল নাগাদ, গুরুরই পরামর্শে ভাগবতপুরাণের একাদশ স্কন্ধের মারাঠি ভাষ্য রচনার কাজ শুরু করেন। পৈঠানে থেকে পাঁচটি অধ্যায় লেখার পর সুদূর বারাণসীতে চলে আসেন। ১৫৭৩-এর শেষ দিকে সমাপ্ত করে ফিরে যান। আর তারই কিছু পরে আবার তুলসীদাসের বারাণসীতে প্রবেশ (১৫৭৪)। কেউই কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি। আমরা কেবল সাল-তারিখের হিসেব করে কল্পনার ফানুস ওড়াতে পারি, যদি ওঁদের দেখা হত এই ভেবে! কিন্তু দেখা হলেও, তাঁদের আলাপ কীরকম হতে পারত, সেই কাল্পনিক সংলাপ কি আর ভেবে উঠতে পারি— যা পারতেন প্রয়াত শিশিরকুমার দাশ কিংবা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর মতো আলেম কবিরা ?

 

কিন্তু একনাথ পৈঠান ছেড়ে বারাণসীতে এসে ওই রচনা কেন সমাপ্ত করেছিলেন, তার কোনো কারণ দর্শাননি। অথচ সূচনা আর সমাপ্তির দিনক্ষণ সবই জানিয়েছিলেন। ওই গ্রন্থ ‘একনাথী ভাগবত’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। ওই পরিশ্রমসাধ্য কাজের ফাঁকেই আবার ‘রুক্মিণী-স্বয়ংবর’ (১৫৭১) নামে কৃষ্ণ-রুক্মিণীর প্রেমোপাখ্যানও লিখেছিলেন। রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে কবি একনাথকে চিনে নিতে হয়তো সুবিধে হয় এর দরুন।
বলা হয়, বারাণসীতে তাঁর মারাঠি ভাষায় লেখা ভাগবতের ভাষ্য নিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে হেনস্তা জুটেছিল। কিন্তু পরে ওই ভাষ্যের জন্যই তিনি সম্মাননীয় হয়েছিলেন। বিশেষত বারকরী সম্প্রদায়ের কাছে।

আরও পড়ুন
ব্রাহ্মণের অভিযোগক্রমে বিচারসভার সিদ্ধান্তে তুকারামকে তাঁর পাণ্ডুলিপিও বিসর্জন দিতে হয়েছিল

সন্ত একনাথ স্মারক ডাকটিকিট

জ্ঞানদেব-কৃত ভগবদ্‌গীতার আর একনাথ-কৃত উদ্ধবগীতার (ভাগবতপুরাণের একাদশ স্কন্ধ) মারাঠি ভাষ্যকে সেখানকার ভাগবত সম্প্রদায়ের দেউলের ভিত আর স্তম্ভরূপে মন্তব্য করেছিলেন বহিণাবাই (১৬২৮-১৭০০) তাঁর একটি অভঙ্গে। –‘সন্তকৃপা ঝালী। ইমারত ফলা আলী॥ জ্ঞানদেবেঁ রচিলা পায়া। উভারিলে দেবালয়া॥…জনার্দন একনাথ। খাম্ব দিধলা ভাগবত॥’ নামদেবের ভূমিকাকে প্রাকার নির্মাণ (নামা ত্যাচা কিংকর। তেণেঁ রচিলে তেঁ আবার) আর তুকারামের ভূমিকাকে চূড়ার কলসের রূপকল্পে দেখেছিলেন (তুকা ঝালাসে কলস। ভজন করা সাবকাশ)।

 

কিন্তু ‘একনাথী ভাগবত’ ছাড়াও তাঁর প্রথম রচনা ‘চতুঃশ্লোকী ভাগবত’এর কারণেও কিছু গোলমাল হয়েছিল পৈঠানে। তাঁকে জাতিচ্যুত করার কথাও পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ হয়ে দেবভাষা সংস্কৃতে লেখা ভাগবতপুরাণের ভাষ্য লোকভাষা মারাঠিতে রচনা করে তিনি ওই মহাগ্রন্থকে কলুষিত করেছেন— এই ছিল মূল অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। বলা বাহুল্য, সমাজের মাতব্বর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাই তা করেছিলেন। ‘একনাথী ভাগবত’এর প্রস্তাবনায় আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর বিবৃতিও রয়েছে। তার থেকে সামান্য উল্লেখ এখানে জরুরি।

 

একনাথ বলছেন, ‘সংস্কৃত গ্রন্থকর্তে তে মহাকবী। মা প্রাকৃতীঁ কায় উণাবী। /নবী জুনী ম্‌হনাবীঁ। কৈসেনি কেবীঁ সুবর্ণসুমনেঁ॥’ অর্থাৎ সংস্কৃত গ্রন্থকর্তা মহাকবি ঠিকই, কিন্তু প্রাকৃত কবিরাই-বা ন্যূন কীসে? সোনার ফুলে কি আর নতুন-পুরোনো ভেদ করা যায়!
এর খানিকটা পরে যা বলছেন, সে আরও মারাত্মক— ‘সংস্কৃতবাণী দেবেঁ কেলী। পরি প্রাকৃত কায় চোরা পাসোনি ঝালী। অসোতু মা অভিমান ভুলী। বৃথা ৰোলীঁ কায় কাজ॥’ এর মূলানুগ বাংলা করলে হয় এরকম— সংস্কৃত বাণী দেব করে বিরচন,/ চোরচোট্টা করেছে কি প্রাকৃত বচন?/ এই মিথ্যা অভিমানে ভুলে থেকে আজ/ বৃথা বলে তবে আর হবে কোন কাজ?

 

আবার সেই প্রাকৃতের পক্ষেই তাঁকে বলতে শোনা যায়— ‘আতাঁ সংস্কৃতা কিবা প্রাকৃতা। ভাষা ঝালী যে হরিকথা। তে পাবনচি তত্ত্বতাঁ। সত্য সর্বথা মানিলী॥’ এটিরও মূলানুগ বাংলা করলে হয় এরকম— সংস্কৃত কিংবা হোক প্রাকৃত বচন,/ যে-ভাষায় হরিকথা হয় বিরচন/ তত্ত্বত সমুদ্ধার সে-ভাষাতে হয়,/ সবখানে সত্য বলে মানবে নিশ্চয়। তাঁর আরও কথা হল— দেবতার নেই কোনো ভাষা-অভিমান,/ তাঁর কাছে সংস্কৃত, প্রাকৃত সমান।/ যে-বাণীতে হতে পারে পরমকথন,/ সে-ভাষায় শ্রীকৃষ্ণের তুষ্ট হয় মন।

আরও পড়ুন
লোকজীবনে প্রচলিত এই ধরনের গল্পকথা পাকেপ্রকারে বিদ্বজ্জনরাও একেবারে খারিজ করতে পারেন না

ইন্দ্রায়ণী তীরে বারকরীদের সমাবেশ, আলন্দি, পুনে

এই বিবৃতির আগে-পিছেও আরও কিছু আছে। অনূদিত এই বিবৃতি কেবল একনাথের মাতৃভাষা মারাঠিপ্রীতির অকপট প্রকাশই নয়, ভারতীয় মধ্যযুগের সমস্ত সন্তকবির প্রাণের কথা। ভক্তি ভাবান্দোলনে দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর, পূর্বাঞ্চলে সমস্ত প্রাদেশিক ভাষা বিকাশের মূল কারণ এখানেই। যে-ভাষা সাধারণ মানুষ নিত্য বিনিময়ে অভ্যস্ত, নিজের ভজনপূজনের পাশাপাশি ভক্ত মানুষজনকে নিয়ে কীর্তনের জন্য একনাথ রচনা করেছেন সেই ভাষাতেই হৃদয়স্পর্শী কথা। তাদের মধ্যে থেকে তাদেরই একজন হয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন ‘ভক্তি’র বাণী। ভাগবত সম্প্রদায়ের দার্শনিক ভিত্তিকে মজবুত করেছেন সেই জনমানবেরই ভাষায়। যে-লোকভাষায় কথা বলে মেয়েরা, শূদ্ররা, অশিক্ষিত জনতা। সংস্কৃত ভাষায় লেখা ভক্তিমূলক সাহিত্যকে প্রবচন অনুষ্ঠানে মারাঠির মাধ্যমে সুগম করতে গিয়ে এভাবেই সংস্কৃত পরম্পরার সঙ্গে লোকভাষা মারাঠির সেতুরচনা সম্ভব হয়েছিল। সংস্কৃতের দুর্লঙ্ঘ্য দরজা যাদের পথ অবরোধ করেছিল, তাদের কাছে ভাগবত ধর্মের বাণী পৌঁছোল কীর্তনের আসরে লোকভাষায় গান হয়ে। লোকে শুনল প্রবচন। উচ্চবর্ণের সাংস্কৃতিক দম্ভ যেখানে ধর্মের গ্লানি বাড়িয়ে তুলেছিল, সেই গ্লানি থেকে মুক্তির মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য লোকভাষা মারাঠির জানলা খুলে সুবাতাস আনলেন সন্ত একনাথ। সহজ মার্গ দেখালেন।

 

আর এই ভাষার প্রশ্নেই আমরা একবার দেখে নেব উত্তর ভারতের সন্তশিরোমণি, তদ্ভব সংস্কৃতির নায়ক কবীরের বচনে যা বলা হয়েছিল— ‘সংসকিরত ভাষা পঢ়ি লীন্‌হা জ্ঞানী লোক কহো রী।/ আসা তৃস্নামেঁ ৰহি গয়ো সজনী কামকে তাপ সহো রী॥/ মান-মনীকী মটুকী সির পর, নাহক ৰোঝ মরো রী।/ মটুকী পটক মিলো পীতমসে সাহেৰ কৰীর কহো রী॥’ অর্থাৎ, প’ড়ে ভাষা সংস্কৃত নিজেকেও ভাবলে জ্ঞানী।/ আশা-তৃষ্ণার প্রবহণ— সেখানেই করলে গাহন, হায় সজনী!/ কামজ্বর সহ্য করো। গাগরি মাথায় ধরো— / মানা আর মানিয়ে নেওয়ার ওই গাগরি।/ মিছে এত বইলি বোঝা, গাগরি ভাঙ না সোজা।/ বঁধুয়ার পরশ নে না তুই এখনই,/ এ-কথা কবীর বলে,ও সজনী!

আরও পড়ুন
এই যে জাতি বিচার করে দেবস্থানে প্রবেশের অধিকার, বর্ণবিভক্ত ভারতীয় সমাজে এটাই দীর্ঘকালের রীতি, ব্রাহ্মণ্যবাদের ফসল

পালকি যাত্রার আগে বারকরীদের বিনোদন, দেহু, পুনে

আবার অন্যত্র এমন কথাও পাওয়া যায়— ‘সংসকিরত কূপজল কৰীরা ভাষা ৰহতা নীর।/ জব চাহোঁ তভি ডূৰৌ শান্ত হোয় শরীর॥’ প্রবহমাণ ভাষাই তো সন্তজনের অবলম্বন। তাঁরা তো আর পণ্ডিত ছিলেন না, যে, দেবভাষা সংস্কৃত আশ্রয় করবেন। ভক্তের সহজ হৃদয়ের কথা তাই লোকজীবনের প্রাত্যহিক ভাষাকে আশ্রয় করেই ব্যক্ত হয়েছিল। এক্ষেত্রে কবীরের ‘পূর্বী বোলী’তে তাঁর বচনের অপার শক্তির কথাও বলা হয়েছে।

 

এই ভাষার প্রশ্নেই দেখা যায়, মারাঠির সঙ্গে হিন্দুস্তানি ছাড়াও সেকালের দরবারি ভাষা ফারসি এবং আরবি থেকে আসা বহু শব্দের মিশ্রণে একনাথ এক অদ্ভুত ভাষা সৃষ্টি করেছিলেন নিজের রচনা-বিশেষে, যা ‘ভারুড়’ নামে পরিচিত। এর কথা আগের পর্বেও উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে কিঞ্চিৎ বিস্তারে বলা দরকার এখানে।

 

‘ভারুড়’ শব্দের সন্তোষজনক কোনো ব্যুৎপত্তি পাওয়া না গেলেও, নানামুনির নানামতেরও অভাব হয়নি। তবে বিবিধের মাঝে প্রয়াত রামচন্দ্র চিন্তামণ ঢেরের অভিমতটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘শ্রীবিঠঠল: এক মহাসমন্বয়’এ আলোচনাক্রমে মেষপালক বা গবাদি পশুপালক গোষ্ঠী ‘ভরওয়াড়’দের সঙ্গে ‘ভারুড়’এর নিকটসম্পর্কের কথা তিনি বলেছিলেন। ভিক্ষাজীবী গায়ক-নর্তক সম্প্রদায় ‘গোন্ধলি’দের গানকে যেমন ‘গোন্ধলগীত’ বা শুধুই ‘গোন্ধল’ বলা হয়, সেরকমই ‘ভরওয়াড়’দের গান ‘ভারুড়গীত’ বা সংক্ষেপে ‘ভারুড়’।

আরও পড়ুন
বারকরী সন্ত হয়ে ওঠার আগে গোরা নাকি নামদেবকে পরীক্ষা করে বুঝেছিলেন পাত্রটি পুড়ে তেমন পাকা হয়নি

অজানবাগে ‘জ্ঞানেশ্বরী’ পাঠরত বারকরী ভক্তরা, আলন্দি, পুনে, ছবি: লেখক

গুজরাতি ‘ভরওয়াড়’ অর্থে পশুপালনকারী বা পশুরক্ষক গোষ্ঠীর লোকজন— সে মেষপালক কিংবা গোরু-মোষ-ছাগল পালনকারী যেমনই হোক, মারাঠি ‘ধনগর’রা যেরকম। ‘ভরওয়াড়’দের পরম্পরাগত জীবনযাত্রায় নিজেদের পশুসম্পত্তি ছাড়া কৃষিশ্রমিকের জীবিকাই বর্তমানে তাদের আয়ের প্রধান উৎস এবং কারও-বা নিজস্ব জমিজমাও রয়েছে। নিজেদের এরা শ্রীকৃষ্ণের পালকপিতা নন্দর বংশজাত বলেও মনে করে। অর্থাৎ তারা ‘আভীর’ বা ‘আহির’ জাতির লোক। মথুরার গোকুল থেকে দ্বারকার উদ্দেশে তাদের পরিযাণপথে সৌরাষ্ট্র ছাড়াও রাজস্থানের মেবারেও একদা ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্তত সেরকমই বলা হয়। রামচন্দ্র ঢেরে অবশ্য এসব জানাননি, অন্য সূত্রে জানা যায়।

 

মহানুভব সম্প্রদায়ের ‘সাতিগ্রন্থ’র (সপ্তগ্রন্থ) অন্যতম ‘ঋদ্ধিপুরবর্ণন’এ একজায়গায় ‘ভারুড়’ শব্দের বিশিষ্ট প্রয়োগ লক্ষ করে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘রত্নপ্রভেচেনি কোডে। মেঁঢিয়া শৃঙ্গারিতীঁ ভারূডেঁ’ (ভারুড়গণ তাদের মেষগুলিকে মর্তমায়ায় সাজিয়ে তোলে), এই বচনে ‘ভারুড়’এর সঙ্গে রাখালিয়া জীবনের সম্পর্কই প্রকাশ পাচ্ছে। এর দরুন তিনি রাখালদের বিশ্রামকালীন নিজস্ব বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে ‘ভারুড়গীত’ বা ‘ভারুড়’কে দেখেছিলেন।

আরও পড়ুন
গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির নিগ্রহ থেকে বাঁচতেই সংকেতলিপি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন মহানুভবরা

জ্ঞানেশ্বরমন্দিরে আগত এক ভক্ত,  পেছনে তাঁর একনাথের উদ্দেশে স্মারক, আলন্দি, পুনে,  ছবি: লেখক

 

গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন মানুষের হাবভাব, কথাবার্তা অনুকরণ করে তারা যেমন নিজেদের খেয়ালে অভিনয় আর গান দু-টিকেই অঙ্গাঙ্গি করে তোলে, ‘ভারুড়’ আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে উপস্থাপনেও তো সেই একই ব্যাপার। আর বিট্‌ঠল তো ‘রাখালরাজা’, তাই তাঁর অনুচরদের নিজস্ব লোকগানের ছাঁদেই সন্তজনের আধ্যাত্মিক মনন আপামর মানুষের কাছে পৌঁছোনোর উত্তম পন্থা হয়ে ওঠে— আরও অনেককে ভাগবতসমাজীর নিজস্ব পরিমণ্ডলে ‘সৎসঙ্গী’ করতে চেয়ে।

 

একনাথের আগে জ্ঞানদেব এবং নামদেবের ভণিতায় রূপকাশ্রয়ী গানের নমুনা পাওয়া যায়, তুকারামেরও সেরকম আছে। কিন্তু একনাথের রচনার মতো এত বেশি সংখ্যক আর বৈচিত্র্যে ভরা নয়। এত বিশাল সামাজিক পটভূমিতেও সেসব লেখা হয়নি। কে নেই, আর কী নেই তাঁর সেই রূপকাশ্রয়ী রচনায়, সেটাই প্রশ্ন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, পশুপাখি, জীবনযাপনে ব্যবহার্য বস্তু, খেলাধুলো, লোকাচার সবই ‘ভারুড়’এ রয়েছে।

 

হিন্দুসমাজের চতুর্বর্ণ ব্যবস্থায় অতিশূদ্র মহার, মাংগ যেমন, তেমনি ডোম্বারি, কোলহাটি, গারুড়িদের মতো ভবঘুরে উপজাতির লোকজনও। আবার যোগী, জঙ্গম, দরবেশ, ফকির, কিংবা তুলজাভবানীর ভক্ত সম্প্রদায় ভুত্যা, গোন্ধলি ছাড়াও জেজুরির খণ্ডোবার দেবদাস বাঘ্যা, ধর্মীয় ভিক্ষুক বাসুদেব আর বালসন্তোষরাও সেখানে উপস্থিত। এমনকী ভাণ্ড, কুণ্টীনদের মতো নিন্দিত মহিলারাও। লোকদেবী ইয়লমা, জোগবা, মেসাবাই, মরিআই। আবার প্রতিবন্ধী মানুষজনও, বিভিন্ন গণৎকার, এমনকী হিজড়েও। পশু-পাখি-কীট-সরীসৃপ ছাড়াও শিশুর দোলনা, এমনকী কুয়োর জল তোলার কপিকলও ‘ভারুড়’এর অন্তর্গত। এসবের দীর্ঘ তালিকা আমার কাছে প্রস্তুত থাকলেও আপাতত এটূকুই যথেষ্ট এখানে।

আরও পড়ুন
বীরশিলা পুজোর সাবেক প্রকরণ বদলে যায় তাকে মানবিক অবয়ব দানের পর

একনাথের উদ্দেশে স্মারকস্থান, আলন্দি, পুনে, ছবি: লেখক

এত বিচিত্র বিষয়ে একনাথ তাঁর ‘ভারুড়’ রচনার সময় সম্পূর্ণ দ্বিধাহীনভাবে ভদ্রাভদ্র, শ্লীল-অশ্লীলের মাপকাঠি সরিয়ে রেখে অন্তেবাসী মানুষজনের বাচনকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই বিরল সাহসী ভাষাশিল্পীর এইসব রচনার মূলকথা ছিল ‘ভক্তি’। ভক্তির পথে ভাগবতসমাজের গণতান্ত্রিক প্রসারে নিম্নবর্গীয় বিভিন্ন মানুষকে জাতি-বর্ণগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ‘ভক্ত’ পরিচয়ের গৌরব দেওয়ারই চেষ্টা করেছিলেন।

 

ভাষাক্ষেত্রে কতখানি সংস্কারমুক্ত ছিলেন, তার সামান্য উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। হিজড়েদের স্যাঙাত ‘মুণ্ডা’র বাচনে বলছেন— ‘ হমহী মুণ্ডা তুমহী মুণ্ডা মুণ্ডা তেরা ৰাপ।/ তেরে ৰাপনে গদ্ধা চোদা হমকু লাগে পাপ॥’ এর পরে আবার বলছেন— ‘সৰ দেবন মে ব্রহ্মা ৰড়া পড়তা চারী বেদ।/ সরস্বতীসে হাল হুবা জৰ ব্রহ্মা ৰেটী চোদ॥’ শিব সম্পর্কে বলা হচ্ছে— ‘ঢবলা গিরী পর্বতম্যানে শম্ভু করতা তপ।/ ভিল্লিণীকী গাঁঠ পড়ী জৰ তপ হুবা গপ ॥’ অর্থাৎ ধওলাগিরি পর্বতে রয় শম্ভু সাধনায়— / ভিলঝিউরির খপ্পরে জপ গপ্পো হয়ে যায়। ভিলরমণী তো কালো, ইঙ্গিতটা সেদিক থেকে কালীর দিকে। আর পরাশর মুনি সম্পর্কে— ‘পারাশরকী নুনী উঠী ঠিবরন লগী মিঠী।/ জমুনামেঁ সংগ ভয়ো জৰ ব্যাস ব্যাস কর উঠী॥’ মূলানুগ বাংলা করলে হয়— পরাশরের চড়তি নুনু, তাই জেলেনি মিঠে,/ জলযমুনায় সঙ্গ হলে ব্যাস ব্যাস করে ওঠে।

 

তাঁর একাধিক ভারুড়ে আল্লা এবং নবির নাম নিয়েই ভিক্ষুকরা গৃহস্থের দ্বারে উপস্থিত হয়েছে। উদ্ধৃত রচনাটিরও শুরুতে যেমন ‘অল্লা তুহী তুহীরে। নৰী তুহী তুহীরে’ (আল্লা তুঁহু তুঁহু রে, নবি তুঁহু তুঁহু রে), তেমনি আবার অন্য আরেকটিতে ‘অল্লা রখেগা বৈসাভী রহনা। মৌলা রখেগা বৈসাভী রহনা’ (আল্লা রাখেন যেমন আমায়, তেমনি আমি রইব/ মালিক আমায় রাখেন যেমন, তেমনি করে রইব)-ও ধ্রুবপদ হয়ে আছে। তাঁর সময়ে হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনারই স্মারক এসব।

আরও পড়ুন
সুলতানি আমলে পনঢরপুরের দেবস্থানেও নাশকতার আশঙ্কা কিছু কম ছিল না

জ্ঞানদেবমন্দির চত্বর, আলন্দি, পুনে, ছবি: লেখক

এসব ছাড়া তাঁর আরও কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা থাকলেও, বিশেষভাবে বলতে হয় জ্ঞানদেবের গীতাভাষ্য ‘ভাবার্থদীপিকা’ (১২৯০) বা ‘জ্ঞানেশ্বরী’র সম্পাদনার কথা। সুদীর্ঘকাল প্রকাশ্যে ওই গ্রন্থের প্রবচন বন্ধ ছিল, বলা হয়। হাতে-লেখা পুঁথির প্রচলনে প্রচুর পাঠভেদও ঘটেছিল। সেসব সংগ্রহ করে ষোলো শতকে তার সম্পাদনা (১৫৮৪) করেন একনাথ। এই সম্পাদনার ক্ষেত্রে তাঁর একটি বিবৃতিও আছে, তার সঙ্গে আলন্দিতে (পুনে জেলা) জ্ঞানদেবের সমাধি উদ্ধারের প্রসঙ্গও জড়িত। মহারাষ্ট্রের ভাগবতসমাজে ওই সূত্রে তিনি নামদেবের যুগের পুরোনো গৌরবও ফিরিয়ে এনে বারকরীদের ভক্তি ভাবান্দোলনকে পুনরুদ্ধার করেন। তার আগে একনাথের প্রপিতামহ ভানুদাসেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে প্রসঙ্গে আপাতত যাওয়ার দরকার নেই। তবে এখানে ‘জ্ঞানেশ্বরী’ সম্পাদনা সূত্রে তাঁর বিবৃতিটি উল্লেখ করা জরুরি। তিনি যা লিখেছিলেন (শ্রী জ্ঞানদেবেঁ যেঊনী স্বপ্নান্ত। সাংগিতলী মাত মজলাগীঁ) সরাসরি তার বাংলা অনুবাদই এখানে পেশ করা হল—

জ্ঞানদেব স্বপ্নমাঝে দিলা দরশন,   
অবাক করিলা হেন তাঁর বিবরণ।

মদনমুরতি সেই দিব্য তেজোময়
পরমপুরুষ কহে বচননিচয়—
অজানবৃক্ষের মূল কণ্ঠরোধ করে,
আলন্দি যাইয়া তবে কাড়ো বেগভরে।
হেন স্বপ্নে আইলাম অলংকাপুরীতে
নদীমাঝে সেইমতো দ্বার নেহারিতে।
পূর্বপুণ্যফলে কহে একাজনার্দন,
লভিলাম জ্ঞানেশ্বরে শ্রীগুরু কারণ।

 

এই বিবৃতি সূত্রে ‘অজানবৃক্ষমূলে জ্ঞানদেবের কণ্ঠরোধ’ হওয়ার বিষয়ে রামচন্দ্র দত্তাত্রেয় রানাডে (১৮৮৬-১৯৫৭) বলেছিলেন, একনাথ কোনো কণ্ঠরোগে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন এবং ওই সময় তাঁর পূর্বসূরিকে স্বপ্নে দেখেন (যাঁর সঙ্গে একনাথের সময়ের ব্যবধান তিন শতাব্দীর), যিনি তাঁর কণ্ঠে-জড়ানো বৃক্ষমূল উৎপাটনের নির্দেশ দেন একনাথকে। প্রসঙ্গত, ‘অজানবৃক্ষ’ (Ehretia Laevis; সং. চর্মবৃক্ষ) আলন্দিতে জ্ঞানদেবের সমাধিমন্দিরচত্বরে আজও বর্তমান এবং আকারও বিশাল। এমনকী ‘অজানবাগ’ নামেও মন্দিরের পার্শ্ববর্তী স্বতন্ত্র একটি পরিসর আছে। বারকরী ভক্তজন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, সেখানে ‘জ্ঞানেশ্বরী’ পাঠ করেন। পাথর-বাঁধানো মেঝেতে ছোটো মাপের পরিষ্কার কাপড় বা আসন জাতীয় কিছু্র ওপর গ্রন্থ রেখে, কেউ-বা ছোটো একটি চৌকির ওপর লাল বা গেরুয়া শালুতে মোড়া গ্রন্থখানি মেলে দিয়ে ভক্তিভরে যখন খুবই মৃদুস্বরে পাঠ করতে থাকেন, তাঁদের মিলিত কণ্ঠের গুঞ্জনে ওই অঞ্চল ভরে থাকে। আলাদাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণও করে। মন্দিরচত্বরেই আরেক অংশে একনাথের ‘জ্ঞানেশ্বরী’ সম্পাদনা এবং জ্ঞানদেবের সমাধি উদ্ধারের কথা মনে রেখে পাঁচিল-ঘেরা ছোটো পরিসরে একটি ফলকও উৎকীর্ণ আছে দীর্ঘকাল।

আরও পড়ুন
তাহলে এ কেমন স্বরূপপ্রকাশ যাঁর বিগ্রহের সঙ্গে অন্য কোনো বৈষ্ণব মূর্তির সাদৃশ্য নেই?

জ্ঞানদেবমন্দির চত্বরে বারকরীদের বিনোদন, আলন্দি, পুনে, ছবি: লেখক

 

যাই হোক, বিবৃতিতে যা বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো, জ্ঞানদেবের সমাধির অবস্থান নদীগর্ভে এবং কোনো গর্ত দিয়ে সেখানে পৌঁছোনোর কথাও বলা হয়েছে— ‘নদীমাঝারীঁ দেখিলেঁ দ্বার’। তা হয়ে থাকলে, বর্তমানের তুলনায় ইন্দ্রায়নী মন্দিরের আরও কাছ দিয়ে প্রবাহিত হত, আর মন্দির তখন প্রবাহের মাঝে থাকার ফলে নদীজলে বিধৌত হওয়াই স্বাভাবিক। আলন্দির স্থানীয় লোকজন এবং বারকরী সম্প্রদায়ের কিছু লোকের সঙ্গেও আলাপচারিতায় শুনেছি, সিদ্ধেশ্বর শিবলিঙ্গের নিকটবর্তী বৃষমূর্তির নীচে জ্ঞানদেবের সমাধিস্থান। একনাথের সময় ওই মন্দির ইন্দ্রায়নীর জলে ডুবে থাকা কিছু আশ্চর্যের নয়। পনঢরপুরে পুণ্ডলিকমন্দির যেরকম নদীগর্ভে, বা ভীমার হাঁটুজলে বর্ষা ছাড়া অন্য সময় ডুবে থাকে। বর্ষার সময় বহুলাংশই ডুবে যাওয়ার কারণে ওই মন্দিরস্থ শিবলিঙ্গের পেতলের মুখাবয়ব খুলে এনে অন্যত্র পূজার্চনা করা হয়।

(পরবর্তী অংশ রবিবারের বদলে আগামী শনিবার প্রকাশ পাবে)

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থ-সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য বইগুলি: কবিতা : 'সমাচার দর্পণ', 'মায়াবন্দর', 'খণ্ডিত শ্লোকের দিনে', 'চন্দ্ররেখার সনেট', 'ছিন্ন ডুরি জোড় দিয়ে'। গদ্য: 'কলকাতার রঙ্গিণীকথা'। অনুবাদ : 'কবীর ও তাঁর কবিতা', 'কবীর-বীজক ও অন্যান্য কবিতা'। সম্মাননা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি-র লীলা রায় স্মারক পুরস্কার (২০০২), সাহিত্য অকাদেমি অনুবাদ পুরস্কার (২০০৫)

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!