রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এ কথা মান্তে হবে যে রাষ্ট্রিক সাধনা ভারতের সাধনা নয়।…কিন্তু ভারতের একটি স্বকীয় সাধনা আছে; সেইটি তা’র অন্তরের জিনিষ। সকল প্রকার রাষ্ট্রিক দশা-বিপর্য্যয়ের মধ্য দিয়ে তা’র ধারা প্রবাহিত হ’য়েছে।… ভারতের এই আন্তরিক সাধনার ধারাবাহিক রূপ যদি আমরা স্পষ্ট দেখ্তে পেতুম তাহলে ভারতের প্রাণবান্ ইতিহাস যে কোন্খানে তা আমাদের গোচর হতে পার্ত।’ সেই সাধকদেরই একাংশ বিশিষ্ট হয়ে আছেন ভারতীয় মধ্যযুগের ‘সন্ত’ বা ‘সন্তকবি’ নামে। সেদিকে দৃষ্টিপাত করে তাঁদের কথা অন্যদের জানিয়ে গেছেন ক্ষিতিমোহন সেনের মতো আরও কেউ কেউ। সন্তদের প্রসঙ্গে দেশি-বিদেশি উভয় দিকেই পরে চর্চা হয়েছে বিস্তর। কেমন ছিল তাঁদের যাপনকথা? তাঁদের মরমি বচনগুলির সারকথাই-বা কী ছিল? একালে তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? এরকম আরও সব প্রশ্নের আলোচনায় গত মাস তিনেক ধরে কৌতূহলীর প্রবেশক হয়ে উঠেছে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক রচনা সন্তজনের মুক্তধারায়। উত্তর ভারতীয় সন্তশিরোমণি কবীর ছাড়াও মহারাষ্ট্রীয় সন্তদের বচনপ্রবাহে ডুব দিয়ে বাঙালি পাঠকের অনেক অজানা কথাই প্রকাশ করেছেন লেখক ভিন্নসময়-এর এই ধারাবাহিকে। কিন্তু সেও হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আজ রবীন্দ্রনাথের ১৬০তম জন্মজয়ন্তীতে তার শেষ পর্ব প্রকাশ পেল।
‘জ্ঞানেশ্বরী’ সম্পাদনার (১৫৮৪) পর একনাথ আরও বছর পনেরো জীবিত ছিলেন। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে ‘ভাবার্থরামায়ণ’ রচনা শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি। পাঁচটি কাণ্ড সমাপ্ত করে যুদ্ধকাণ্ডের চুয়াল্লিশটি অধ্যায় লিখেছিলেন। পৈঠানে তাঁর জীবনাবসান (১৫৯৯) হলে, বা তিনি গোদাবরীতে ‘জলসমাধি’ গ্রহণের পর দৌহিত্র কবি মুক্তেশ্বর এবং আরও কয়েক জন মিলে ‘ভাবার্থরামায়ণ’এর উত্তরকাণ্ড লিখে একনাথের আরব্ধ কাজকে সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করেন।
জীবদ্দশায় একনাথ বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন (১৫৬৫) দেখেছিলেন। সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জঘন্য হাল তাঁকে বিচলিত করেছিল। ভিন্নধর্মী শাসকের পদানত স্বদেশ আর নৈতিকভাবে অধঃপতিত এক সমাজ। সেখানে ন্যায়পরায়ণ বীরধর্ম ? হ্যাঁ, তারই জাগরণের পক্ষে উচ্চাকাঙ্ক্ষা গড়ে তোলার তাগিদও অনুভব করেন। তখনকার রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে রামায়ণ অবলম্বন করে তাই সমাজের মাতব্বরদের কাছে রাজা আর বীরের ধর্মকেই স্মরণ করাতে চেয়েছিলেন। তাঁদের আত্মদানে, দুঃখভোগে সামাজিক কর্তব্য পালনে দায়বদ্ধ করতে চেয়ে। ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামিকেও এই সূত্রে সমালোচনা করেন। কোনো মহাকাব্য নয়, বরং শিক্ষিত পুরাণকারের মতো একটি পুরাণ রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন রামায়ণের আখ্যান অবলম্বনে, নিজের সাম্প্রতিকে অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষজনের কথা মনে রেখে।

আরও পড়ুন
সংস্কৃতের বদলে মারাঠিতে ভাগবতভাষ্য লেখায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে অপদস্থ হয়েছিলেন একনাথ
স্বজাতির দুর্বলতা কোথায় তা ভালোমতোই জানতেন। আর সেই জানার দরুনই তাঁর ভাগবত ধর্মসিক্ত মানস অন্ত্যোদয়ের সংকল্পে অবিচল থেকে রচনা করেছে ‘ভারুড়’, যা মারাঠি সাহিত্য, লোকশিল্প এবং সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় তাঁর বিশিষ্ট অবদান হিসেবেই স্বীকৃত। নিম্নবর্গীয় বিভিন্নজনের মুখ দিয়ে ‘ভক্তি’র কথা প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর এমন কিছু রচনা রয়েছে, প্রাথমিকভাবে তা হয়তো অনেকের কাছেই অশ্লীল মনে হবে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে সেরকম রচনায় আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ছাড়াও প্রান্তিক মানুষের অন্তরগত ক্ষোভের প্রকাশও খুঁজে পাওয়া সম্ভব। যে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ‘ফকির’কে নিয়ে, ‘দরবেশ’কে নিয়ে, কিংবা কোঙ্কণ উপকূলের ইথিয়োপীয় অভিবাসী ‘হাপসী’কেও সেখানে হাজির করেছেন, তাঁদের বক্তব্যের বয়ান আলাদা হলেও এবং অন্য মেজাজের হওয়া সত্ত্বেও, সেসব ষোলো শতকে হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনার স্বরূপ বুঝতেও সহায়ক হয়ে আছে। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার একটি ‘হিন্দু-তুর্কসংবাদ’। যথেষ্ট মজাদার উভয় পক্ষের উতোর-চাপানের বয়ানগুলি। তখনকার ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক সংকট যেমন, সেইসঙ্গে পারস্পরিক সহাবস্থানে সহিষ্ণুতাও যে ক্রমশ গড়ে উঠছিল, তারও নিদর্শন।

ভাঙা হিন্দুস্তানি আর মারাঠির মিশ্রণে সেইসব বয়ান ছাড়াও আরবি-ফারসির প্রয়োগে একনাথ তাঁর কালের বিভিন্ন প্রশাসনিক চিঠিপত্রের ধাঁচেও কিছু ভারুড় রচনা করেছিলেন। বলতে গেলে সেসব অনুচ্ছেদমূলক গদ্যকবিতাই। মারাঠিতে সেই কোন যুগে তার প্রবর্তন হয়ে গেছে! সেসবের কোনো খোঁজই রাখি না আমরা। বঙ্কিমচন্দ্র যার প্রস্তাবই করেননি শুধু, প্রবর্তকও ছিলেন বাংলায়। ক-জনই-বা তার খোঁজ রাখে! এখন রিলে রেসের ব্যাটন পাওয়ার মতো অন্য সূত্রে সেটা পেয়ে গিয়ে ছন্দবোধহীন বে-আন্দাজিরা সেই ধরনের রচনা পাত পাত লিখে চলেছে।
আরও পড়ুন
ব্রাহ্মণের অভিযোগক্রমে বিচারসভার সিদ্ধান্তে তুকারামকে তাঁর পাণ্ডুলিপিও বিসর্জন দিতে হয়েছিল
‘অর্জদস্ত’(আবেদনপত্র), ‘জাবচিঠ্ঠী’ (হুন্ডির পক্ষে জবাবি চিঠি), ‘তাকীদপত্র’ (নিষাধাজ্ঞামূলক সরকারি চিঠি), ‘কৌলপত্র’ (কৌলনামা বা কবুলনামা), ‘অভয়পত্র’, ‘জমাখর্চ’ (জমা-খরচ) প্রভৃতি রচনায় একনাথের সময়কে তার নিজস্ব বাস্তবতায় অনেকখানি চিনতে পারা যায়।
মহারাষ্ট্রে তখন ভূমি ব্যবস্থা যা ছিল, তার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মচারী, চাষি, খেতমজুর, সামাজিক বিভিন্ন স্তরে প্রাপ্ত ফসলের বাঁটোয়ারা, নানারকম আদান-প্রদান, গ্রামের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির বিস্তর উল্লেখে সমৃদ্ধ তাঁর ‘রূপক’ধর্মী এইসব রচনা। মূলকথা ‘ভক্তি’, কিন্তু সেও আবার দেহতত্ত্বকে এড়িয়ে নয়। উপরিভাগে তার বস্তুপৃথিবী, যাবতীয় সামাজিক সম্পর্কের বিন্যাস। কিন্তু সেসবের তলে আসলকথা অন্য।
আরও পড়ুন
লোকজীবনে প্রচলিত এই ধরনের গল্পকথা পাকেপ্রকারে বিদ্বজ্জনরাও একেবারে খারিজ করতে পারেন না
এখানে তার সহজ একটি উদাহরণ দেব যথাসম্ভব মূলানুগ বাংলায়। জমি চাষের নিশ্চয়তা স্বরূপ চাষিকে চুক্তি বা নিযুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকার পক্ষের লিখিত চিঠি যা ‘কৌলনামা’ বা ‘কবুলনামা’ নামে পরিচিত ছিল, সেই চিঠির আদলে।
কৌ ল প ত্র
চিরঞ্জীব জীবাজিপন্ত থানাদারকে আত্মরামপন্ত কমাবিসদার, কসবা ব্রহ্মপুরী, আশীর্বাদ তদুপরি। তোমাকে দেহগাঁওয়ের থানা দেওয়া হইয়াছে। এহেন থানাতে সাবধানী আচরণ করিবে। তথায় মমতাই পাটিলনি তাহার মিথ্যা দম্ভ উদ্ভব করিয়াছে। কামক্রোধাদি ষড়বৈরী চাকর রাখিলে লোভ-মোহের ফান্দে সিদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। একারণ তোমাকে সূচনা মাত্র লিখিত হইল। বিষয়ের লোভ না ধরিয়া নিজহিতে অবহেলা না করিয়া সত্য-মিথ্যা জানিয়া বিচারের পথ ধরিয়া অবিচার ত্যাগ করিবে। বিবেক সদ্ভাব মিত্রত্ব বিশেষ অশ্রু দিয়া তদ্বুদ্ধি দ্বারা গাঁয়ের খেত প্রস্তুত করিবে। উত্তম চার বর্ণকে কৌল দেওনে ধৈর্যের লাঙ্গল ধরিয়া খেতমধ্য আল বাঁধিয়া বাসনার পল্লব টুটিয়া সংশয়ের কুশ উৎপাটিয়া ভূমি শুদ্ধ করিলে তাহার পর ভক্তি-জ্ঞান-বৈরাগ্য ‘তিফণী’ করিবে। সদ্গুরুরূপী নিজবীজ বপনে তথায় শুদ্ধসত্ত্বের মেঘ বর্ষাইলে সত্যের ঠিকা রুজু করিয়া কুতর্কের পাখি উড়াইবে। জাগিয়া জাগিয়া বিশ্বাস রক্ষা করতঃ খেতের মাল গোলা করিবে। সকল ষড়গুণ ঐশ্বর্যবলদ জুতিয়া মাল ঝাড়াই করিয়া প্রচুর ফসল তুলিবে, আনন্দের রাস করণে। তথায় আবার সিদ্ধসাধকগণ আসিলে ভক্তিভরে তাঁহাদের পদলীন হইবে। সকল মাল মাপিয়া সহুজুর ব্রহ্মপুর আসিয়ো। গোষ্ঠীতে এসকল শুনাইবে নচেৎ চৌরাশি লক্ষ যোনিতে ঘুরিয়া ফিরিলে ইহার পর আর কোন দস্ত লাগিবে? কাস্তে চালাও জন্ম-মরণের পথের খুঁটায়। কৃপাসাগর সদ্গুরু জনার্দন কহিলেক তাহাতে জনার্দনের ‘একা’র আনন্দময় সমাধান হইলে দ্বৈতের লেশমাত্র নাই— সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ প্রত্যয় আসিলে সমাধান মিলিল, এই কৌলপত্র।
কয়েকটি শব্দের অর্থ এখানে স্পষ্ট হওয়া জরুরি। যেমন, ‘কমাবিসদার’ হলেন জেলার খাজনা আদায়ের কর্মকর্তা। আবার আরবি ‘কসবা’র অর্থ মহাল বা পরগনার প্রধান শহর। ‘থানাদার’ (হিন্দিতে যা থানেদার,মারাঠিতে তা-ই ঠানেদার) হলেন তালুকের প্রধান কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক। ‘জীবাজিপন্ত’ হলেন জীবাত্মা।‘মমতাই পাটিলনি’ পাটিল বা গ্রামপ্রধানের গৃহকর্ত্রী, এখানে গূঢ় অর্থ মায়া। ‘আত্মরামপন্ত’ হলেন আত্মারাম বা শুদ্ধ চৈতন্য। ‘চার বর্ণ’ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। ‘তিফণী’ (সং ত্রিফণী) চাষের যন্ত্র-বিশেষ। ফারসি ‘দস্ত’এর সাধারণ অর্থ হাত ছাড়াও মূল্যনির্ণয় বা কর, ক্ষমতা বা অধিকার এবং দস্ত করা অর্থে বন্ধ করাও হয়। আবার ‘দস্তক’ অর্থে পরোয়ানা। ‘ষড়বৈরী’ কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-দম্ভ-অহংকার। ‘ষড়গুণ’ ঐশ্বর্য, জ্ঞান ,যশ, শ্রী, বৈরাগ্য, ধর্ম।
সংক্ষেপে এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। লোকায়ত সাধকদের ভেতর অনুমানের চেয়ে বর্তমানের দিকে ঝোঁকটা বেশি বলেই তাঁদের গান প্রকৃতপক্ষে দেহতত্ত্বের গান হয়ে ওঠে। সন্তদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আত্মতত্ত্ব, পরতত্ত্ব পেরিয়ে সেই গানে গভীর রহস্যভরা এই মায়াবী জীবনের উত্তাপ এবং প্রেমানুরাগের উপলব্ধির ছোঁয়া লেগে থাকে। এই কারণেই তাঁদের বচন অন্তর্মুখী এবং গহন সংকেতপূর্ণ। পরাপ্রকৃতিকে অপরাপ্রকৃতির মাঝে প্রেমভক্তির পথে উপলব্ধি করতে পরম্পরাক্রমেই তাঁরা পেয়েছিলেন উপনিষদের সূত্রে পিণ্ড-ব্রহ্মাণ্ডের কথা। নানাপ্রকারে সেই ধারণার চিত্রণ সন্তদের রচনায় পাওয়া যাবে।
কবীর যখন বলেন— ‘বাগোঁ না জা রে না জা, তেরী কায়া মেঁ গুলজার’— যাস না রে তুই যাস না বাগানে/ফুল ফোটে তোর দেহে, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, দেহকে সর্বসত্যের ধারক বিবেচনা করেই তা বলেছেন। এমনকী জীবিকার উপকরণ কেন্দ্র করেও বলেন দেহতত্ত্বেরই কথা— ‘ঝীনী ঝীনী বীনী চদরিয়া।/কাহৈ কৈ তানা কাহৈ কৈ ভরনী কৌন তার সে বীনী চদরিয়া।/ ঈংগলা পিংগলা তানা ভরনী সুষমন তার সে বীনী চদরিয়া।…’ বিখ্যাত ভজন, অনেকেই শুনেছেন, অর্থ না বুঝেও হয়তো মাথা নেড়েছেন সুরের টানে, গায়কির মুনশিয়ানায়। এটি কিন্তু সম্পূর্ণই দেহতত্ত্বের গান। আর কবীর তো ছিলেন জোলা পরিবারের মানুষ, তাঁত বোনাই যাদের কর্ম। সেই তাঁতের রূপকেই তাঁর একাধিক রচনায় কায়াসাধনার কথাই পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
বারকরী সন্ত হয়ে ওঠার আগে গোরা নাকি নামদেবকে পরীক্ষা করে বুঝেছিলেন পাত্রটি পুড়ে তেমন পাকা হয়নি
কবীর ছাড়াও শ্রমজীবী সন্তকবিদের অনেকেরই রচনায় তাঁদের বৃত্তির প্রসঙ্গ স্পষ্টভাবেই রয়েছে এবং সেসবে তাঁদের ভক্তির কথা, সাধনার কথা, স্বানুভবই প্রধান হয়ে আছে। মহারাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি, তা আগেও দেখেছি আমরা নামদেব কিংবা সাওতা মালীর রচনা সূত্রে। এখানে নরহরি সোনারের (?-১৩১৩) একটি অভঙ্গে দেখে নেব কায়াসাধনের বা ভক্তিমিশ্রিত দেহতত্ত্বের কথা কীভাবে রয়েছে। তিনি তো স্যাকরা ছিলেন, তাই কাজের উপকরণগুলিকে নিয়েই বলছেন, ‘দেবা তুঝা মী সোনার। তুঝে নামাচা ব্যবহার’ অর্থাৎ স্যাকরা আমি প্রভু তোমার/ তোমার নামের হয় ব্যবহার। সরাসরি বাংলাতেই পরের অংশগুলি এবার পেশ করছি।
নরহরি বলছেন, এই দেহকে সরা জানি/আত্মার নাম সোনা মানি/তিন গুণে ছাঁচ করে ঢালি/ ব্রহ্মরস মধ্যে তার। এবার দেখুন, আরও উপকরণের কথা কীভাবে আসছে— জীব-শিবে বাঁকনল যে ফুঁকি/ দিনরাত হয় ঠোকাঠুকি / বিবেকটিকে হাত্ড়ি করে/কামক্রোধ করি টুকরো ছাড়।
তাহলে বাঁকনল, হাতুড়ি এই দু-টি যুক্ত হল সরা আর ছাঁচের সঙ্গে। এর পর কী করেন? বলছেন— মনবুদ্ধির কাত্রি দিয়ে/রামনামেরই সোনা নিয়ে/জ্ঞানের নিক্তি ধরে হাতে/অক্ষরে দিই ওজন তার।
কাতুরি বা কাঁচি, নিক্তি আর ওজন বা বাটখারা পাওয়া গেল এবার। তারপর? বলছেন দ্রব্য প্রস্তুত হয়ে গেলে, তখন— প্যাঁটরা নিয়ে কাঁধের ’পরে/উতরে আমি যাই ওপারে/স্যাকরা নরহরি এখন/দাস হয়ে সে হরির ভজন/ গাইছে দিবসরাতে তার।
ভাবা যায়? সোনা গলানো যাঁরা দেখেছেন, স্যাকরার কাজের সঙ্গে যাঁদের কিছুমাত্র পরিচয় আছে, এখানে উল্লেখিত সব উপকরণে প্রস্তুত এই রূপক রচনার মাহাত্ম্য আশা করা যায় তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন কিছুটা।
আবার একইভাবে পনেরো শতকের মানুষ সেনা ন্হাবীর রচনায় তাঁর জাত ব্যাবসা হাজামি বা ক্ষৌরকর্মের কথাও যখন বলেন তিনি, ‘আহ্মী বারীক বারীক। করূঁ হজামত বারীক’— বারিক হয়ে আমরা সবাই/ হাজামগিরি করছি গো তাই, সেটাও নজর কেড়ে নেয়। তাঁর কাজের উপকরণ ক-টি বক্তব্য বিষয়কে কীভাবে প্রকাশ করছে, দেখে নেওয়া যাক সরাসরি বাংলায়। তিনি বলছেন, ‘বিবেকটিকে আয়না ক’রে/ বৈরাগ্যের চিমটে ধ’রে /শান্তিবারি শিরের ’পরে/ ছিটাই, অহংশিখা মোড়াই।’ তাহলে জল ছাড়াও দু-টি উপচার পাওয়া গেল এখানে। এর পরে ক্ষুরের ব্যবহার লক্ষণীয়, বলছেন— ‘কামাই বগল ভাবগতিকের,/ নখ কাটি সব কামকুপিতের,/ চতুর্বর্ণে ভরসা দিতে/ স্থির হয়েছে সেনা হে তাই।’
আরও পড়ুন
গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির নিগ্রহ থেকে বাঁচতেই সংকেতলিপি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন মহানুভবরা
যাই হোক, একনাথ প্রসঙ্গে আলোচনাক্রমেই এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা জরুরি। মহারাষ্ট্রীয় সন্তদের অপরার্ধ উত্তর ভারতীয় অংশের বিশিষ্টরাও কিন্তু একনাথের সিংহাবলোকনে বাদ পড়েননি। তাঁর একটি ভারুড়ে (নানক-২) তাই কবীর ও তাঁর পুত্র কমাল, সজ্জন কসাই বা সদনা, দাদূ পিঞ্জারী (ধুনুরি), রুইদাস চামারের উল্লেখে স্পষ্ট হয়ে আছে তাঁর আত্মীয়তার বোধ। নিজের পরম্পরার সঙ্গে উত্তর ভারতীয় সন্তদেরও আপনজন বিবেচনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ছিল। পরবর্তীকালে তুকারামের রচনাতেও যেমন এঁদের উল্লেখ পাওয়া যায় (এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে তা সম্পূর্ণই অনূদিত), সেরকম আধুনিক কালে নানামহারাজ সাখরে সংকলিত ‘সকলসন্তগাথা’তেও প্রাক্তন যোগসূত্রই রক্ষা করতে দেখা গেছে।
ষোলো শতকে এই মহাত্মা ‘জ্ঞানেশ্বরী’র পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি বারকরীসমাজকেও উজ্জীবিত করে তোলেন। পরবর্তী তুকারামের আগমনও তার দরুন অনেকটা সুগম হয়েছিল। মোটের ওপর সাত-আট-শো বছরের প্রাচীন সেখানকার ভাগবত সম্প্রদায়ের ভক্তি ভাবান্দোলনে তাই সন্ত একনাথের গুরুত্ব ভিন্নমাত্রায় বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু সেইসঙ্গে আবার একথাও বলা হয়, একনাথের সংশ্লেষণী বা সমন্বয়ধর্মী অধ্যাত্মচেতনা মারাঠি মধ্যমবর্গের পার্থিব জীবন এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছুটা প্রভাবিত করলেও, হিন্দু সংস্কৃতি এবং ধর্মের ক্ষেত্রে তৎকালীন অবক্ষয়ী দশা রোধ করতে খুব একটা কার্যকরী প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিশেষত, মারাঠা সর্দারদের ওপর মুসলমান শাসকদের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণে মারাঠি জীবনে ইসলামি সংস্কৃতির প্রবেশও অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন
বীরশিলা পুজোর সাবেক প্রকরণ বদলে যায় তাকে মানবিক অবয়ব দানের পর
তার ওপর, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের দরুন হিন্দু রাজশক্তির দিক থেকে প্রতিরক্ষা ছাড়াও ধর্মীয় ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষণারও মান্দ্য ঘটে সেই দুর্দিনে। এর ফলে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রগুলিও ক্রমশ ভুক্তভোগী হতে থাকে— বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের জন্য যেসব অনুদান দীর্ঘকাল ধরে প্রদত্ত হত, সেসবের জোগানে টান পড়ায়। অনাথ পণ্ডিতরা স্বাভাবিক নিয়মেই ধর্ম, শাস্ত্র, দর্শনের নাম করে তখন বাহ্যাড়ম্বরের আশ্রয় নেন, সর্বস্ব হয়ে ওঠে ধর্মের নামে বাহ্যাচার। এরই সঙ্গে জোটে জাতপাতের বিচার, আগের চেয়েও বেশি কঠোর হয়ে। আরেক দিকে, সাধারণের জীবনে দরগা এবং পিরের প্রতি আস্থাও ক্রমবর্ধমান হতে থাকে।
সামাজিক জীবনে অনিশ্চয়তার উৎসে, বলা বাহুল্য, একাধিক যুদ্ধবাজ রাজশক্তির সমাবেশ। একশো আশি বছরের বাহমনি সাম্রাজ্যের পতন এবং তার গর্ভজাত স্বাধীন পাঁচ সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটলেও, মঞ্চে মারাঠা শক্তির প্রতিভূ শিবাজির প্রবেশ তখনও ঘটেনি। উত্তর ভারত ক্রমে সুলতানি আমল থেকে মোগলদের দখলে যাওয়ার পর দক্ষিণে তারা অগ্রসর হচ্ছে। দক্ষিণের শাসকরা ছিল শিয়া গোষ্ঠীভুক্ত, আর মোগলরা সুন্নি। সুতরাং রাজনৈতিক লড়াইয়ের ভেতরই ধর্মীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও সক্রিয় ছিল। ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহে অর্থনৈতিক অবস্থা যা হওয়ার কথা, অনিবার্যভাবে সেটাই হয়েছিল।
সাধারণ কৃষিজীবী মানুষকেও আকস্মিক আক্রমণ থেকে পরিত্রাণে সামরিক উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে— তুলে নিতে হয়েছে শস্ত্র, লাঙল ফেলে রেখে। এর ওপর ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দীর্ঘ অনাবৃষ্টি, অজন্মা, একের-পর-এক দুর্ভিক্ষ, লোকক্ষয়— ধারাবাহিক দুর্দিন।
আরও পড়ুন
সুলতানি আমলে পনঢরপুরের দেবস্থানেও নাশকতার আশঙ্কা কিছু কম ছিল না
এহেন পরিস্থিতিতে মারাঠি সাহিত্যক্ষেত্রও ঊষর হয়ে থাকে। নামদেবের পর অতিক্রান্ত প্রায় তিন শতক। সেই নীরব নির্জনকে মুখর করে তোলেন ষোলো শতকে একনাথ। আর তাঁরই হাতে জ্বালানো দীপাধারে শিখা উসকে দেন সতেরো শতকের মানুষ তুকারাম (১৫৯৮ বা ১৬০৮-১৬৫০)। সাধারণের জীবনে বিট্ঠলের অভ্যর্থনায় তাদের ভক্তিপথে এনে, মানবিকতার শিক্ষায় আবারও দীক্ষিত করেন। নিরক্ষর, বিভিন্ন সংস্কার-কুসংস্কারে বিমূঢ় জনজীবনে তাঁর অনুপ্রেরণা বিশেষ কার্যকরী হয়ে ওঠে বিড়ালতপস্বী আর বকধার্মিকদের খপ্পর থেকে পরিত্রাণে।
বারকরীসমাজের কাছে নিশ্চয় দিশাহীন অনালোকে তিনি বাতিঘরের মতোই হয়ে উঠেছিলেন। যার আলো প্রায় চারটি শতক পেরিয়ে এখনও বহুজনের বিস্ময় জাগায়— তাঁর জীবন আর রচনার পারস্পরিক সম্বন্ধ লক্ষ করে। দীর্ঘসময় যিনি বহির্জগৎ আর অন্তর্জগতের নিরন্তর দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ, বিপর্যস্ত হয়েছেন। তাঁর বাচনের গভীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে আরও তলিয়ে যাঁরা জানতে চান, ক্রমশ বুঝতে পারেন, স্বল্পায়ু জীবনে তাঁর পর্যটনের পথটি ওই পরম্পরার অন্যদের চেয়ে হয়তো অনেকটাই আলাদা ছিল।
কিন্তু সেই নিরভিমান ভক্ত তুকারাম শেষ অবধি কত বছর বেঁচেছিলেন, তা জানা যায় না। বছর বিয়াল্লিশ কিংবা তেতাল্লিশ নাগাদ একদিন তিনি সবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। তাঁর আকস্মিক প্রস্থানে আষাঢ়ে গল্প তৈরি হতেও কোনো অসুবিধে হয়নি। রথে চড়ে তিনি স্বর্গারোহণ করেছেন, এই জাতীয় কথাও বলা হয়। মারাঠি সন্তকবিদের পরম্পরায় প্রধান চার জনের ভেতর তুকারাম ছাড়া বাকি তিন জনের সমাধি আছে। কিন্তু তুকারামের প্রস্থান রহস্যাবৃত। কবীর, মীরাবাই, শ্রীচৈতন্যর ক্ষেত্রেও যেমন।
আরও পড়ুন
তাহলে এ কেমন স্বরূপপ্রকাশ যাঁর বিগ্রহের সঙ্গে অন্য কোনো বৈষ্ণব মূর্তির সাদৃশ্য নেই?
তুকা তাঁর আধ্যাত্মিক উৎক্রমণে ‘সন্তকবি’ হয়ে উঠেছিলেন। মহারাষ্ট্রের ভাগবতসমাজে বা বারকরী সম্প্রদায়ের কাছে দেবতুল্য পুরুষও হয়ে উঠেছেন বহুকাল আগে। ‘জ্ঞানোবা-তুকারাম’ বলে পনঢরপুরের তীর্থযাত্রীরা জ্ঞানেশ্বর থেকে তুকারাম অবধি এক অবিছিন্ন পরম্পরাকে স্মরণ করে জয়ধ্বনিও দেন। যেমন তাঁর অভঙ্গ রাগপ্রধান সুরে কীর্তনীয়া দলে গীত হয়, তেমনই পনঢরপুরে ভীমা নদীর তীরে অন্ধ ভিখারির কণ্ঠে সম্পূর্ণ দেহাতি সুরেও শুনেছি। আবার দেহুতে তাঁর বসতভিটের সংলগ্ন এলাকায় বছরে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে স্মরণ করে উৎসব, জনসমাবেশও হয়ে থাকে। সরকারি তত্ত্বাবধানে তাঁর রচনাবলি প্রকাশের আয়োজনের পাশাপাশি নানারকম পাঠভেদ, প্রাচীন বানানে বিভিন্ন অশুদ্ধি-সহ গ্রন্থও প্রকাশিত হয়ে থাকে। এইসবই চলে তাঁর অমরতাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এসবের ভেতর থেকে ‘কবি তুকারামে’র কোনো আদল পেতে চাইলে, তাঁর ‘হয়ে ওঠা’কে জানতে চাইলে, সেই নির্জন সাহসকে হৃদয়ঙ্গম করতে চাইলে, আমাদের হয়তো কিছুটা অন্যভাবে এগোতে হবে। তাঁর কবিতার পাঠে আমাদেরও যে মানসযাত্রা ঘটে যায়।
(সমাপ্ত)