২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মস্থান বীরসিংহ বাঙালির আবেগে জায়গা করে নিলেও, কর্মাটাঁড় আজও অবহেলিত

ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মস্থান বীরসিংহ বাঙালির আবেগে জায়গা করে নিলেও, কর্মযোগী বিদ্যাসাগরের জীবননাট্যে অনেকখানি জুড়ে-থাকা কর্মাটাঁড় কিন্তু আজও অবহেলিত। তাঁর সেখানকার বাসস্থান ‘নন্দনকানন’ তো বাঙালির ভাষাতীর্থ হয়ে উঠতে পারত। তার দাবিও কোনো অংশে কম নয়। অথচ বাস্তবচিত্রটা অন্যরকম। ‘বিহার বাঙালি সমিতি’ এবং ‘ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি’ সেই কাজেই মনোযোগী এখন। সে-কাজেরও ইতিহাস খুব হ্রস্ব নয়। দীর্ঘ সেই পথ তাঁরা কীভাবে পেরিয়ে এলেন, তার খোঁজই নিয়েছেন বর্ণালী রায়।গতকাল এই নিবন্ধের প্রথমাংশ প্রকাশ পেয়েছিল, আজ  তারই শেষাংশ রইল ‘ফিরে দেখা’য়।

 

 

 

 

একদা মধুপুরের বাসিন্দা, বিদ্যাসাগর-গবেষক অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় জানালেন, সেই সময় কর্মাটাঁড় রেলস্টেশনের (এখন যার নাম ‘বিদ্যাসাগর’) স্টেশনমাস্টার ছিলেন একজন বাঙালি।সরকারি উচ্চ পদে থাকার সুবাদে এলাকার গরিবগুরবোদের সম্ভ্রম আদায় করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অতি সাধারণ মাটির মানুষ,সহজে দীনদুঃখীদের সঙ্গে মিশতে পারঙ্গম বিদ্যাসাগরের কর্মকাণ্ড খুব দ্রুত ওই স্টেশনমাস্টারের জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে গেল। তিনি সেটা ভালোভাবে নিতে পারেননি। তাই বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে জনসমক্ষে কটাক্ষও করতেন। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তাকে একটুও খর্বকরতে পারেননি।

 

শরীর-স্বাস্থ্যের ভগ্নদশার কারণে ১৮৯০-এর গোড়া থেকে আর কর্মাটাঁড়ে বাস করেননি বিদ্যাসাগর। কলকাতার বাদুড়বাগানের বাড়িতেই ১৮৯১ সালে তিনি মারা যান। এখানকার কর্মকান্ডও স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর অনুপস্থিতিতে। ১৮৯৯ সালে তাঁর পুত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দনকাননকে কলকাতার পাথরঘাটা নিবাসী মল্লিক পরিবারকে বিক্রি করে দেন। সেই পরিবার বিদ্যাসাগরের স্মৃতিধন্য এই জায়গাটিকে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করা শুরু করে। ‘বিহার বাঙালি সমিতি’ নন্দনকাননের সন্ধান পায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সত্যেন্দ্রনাথ সেন মারফত। সত্যেন্দ্রনাথ বা সত্যেন সেন পাটনার বিখ্যাত ডাক্তার, জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা এবং পাটনা শহর থেকে তিনবার নির্বাচিত বিধায়ক ডা.অজিতকুমার সেনের আত্মীয় ছিলেন।

 

কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তির রূপকার ভাস্কর আরমেংগিল্ডো বয়েস।

 

সত্যেনবাবু সে-সময় বিদ্যাসাগর রচনাবলী প্রকাশ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ইত্যাদি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত কিছুই কলকাতা শহরে বা বীরসিংহ গ্রামে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না দেখে। কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের শেষ বাসস্থানের কথা তিনি জানতেন, এও জানতেন যে সে বাসস্থানের মালিকানা অন্য কারোর হাতে চলে গেছে, কিন্তু বাসস্থানটির হদিশ জানা ছিল না। তাঁর কথা শুনে ‘বিহার বাঙালি সমিতি’ তখন যেচেই বাসস্থানটি সন্ধানের ভার নেয়। ১৯৩৮ সালে বিহারের প্রবাসী ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা তৈরি করেন এই সংস্থা। ১৯৭০-এর দশক থেকে এই সমিতি বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত কর্মাটাঁড়ের সম্পদ পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। হদিশ মেলে কলকাতার সেই মল্লিক পরিবারের।

 

 

আরও পড়ুন

ঈশ্বরচন্দ্রের সাধের ‘নন্দনকানন’, তাঁর নিজের হাতে গড়া এক কর্মকাণ্ড

 

 

সে-সময় এই সম্পত্তির যিনি মালিক ছিলেন, তাঁর কাছ থেকেই ১৯৭৪ সালের ২৯ মার্চ ২৪ হাজার টাকায় বিদ্যাসাগরের বাড়ি-সহ ৩ একর ১৯ ডেসিমেল জায়গা কিনে নেয় ‘বিহার বাঙালি সমিতি’। শুরু হয় বিদ্যাসাগরের স্মৃতি সংরক্ষণের কাজ। তখন ওখানে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে বা যাকে বলা যায় কেয়ারটেকার ছিলেন কার্তিক মণ্ডল।চাষের জায়গাটা তাঁর ভোগ দখলে ছিল। সমিতির লোকজন কথা বলে জেনেছিলেন কার্তিক মণ্ডলের ঠাকু্রদাকে খোদ বিদ্যাসাগরেরর আমলে নিযুক্ত হয়েছিলেন।একা কার্তিক মণ্ডলের পক্ষে পুরো জায়গাটা সামলে রাখা সম্ভব ছিল না।আশপাশের কয়েকজন মারোয়াড়ি ব্যাবসাদারের নজর ছিল ওই  সম্পত্তির ওপর। একজন চেষ্টাও করেছিল।

 

সমিতির দু-জন প্রতিনিধি গুরুচরণ সামন্ত আর নরেন মুখার্জিকে এর সন্ধান কর্মের ভার দেন ‘বিহার বাঙালি সমিতি’র তখনকার সর্বমান্য নেতা ডা.শরদিন্দুমোহন ঘোষাল। যেহেতু তখন কর্মাটাঁড় যাওয়ার সোজাসুজি কোনো রেলপথ ছিল না, তাই ডাক্তারবাবু নিজের গাড়ি আর টাকাও দেন এই কাজে। দুমকা, মিহিজাম, জামতাড়া হয়ে তিন দিন পর তাঁরা কর্মাটাঁড় পৌঁছোন। রাস্তায় তাঁদের কেউ কোনো হদিশ দিতে পারেনি নন্দনকাননের বিষয়ে।কিন্তু কর্মাটাঁড় রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার (শিবদাস মুখার্জি) সৌভাগ্যক্রমে বাঙালি তো ছিলেনই, কাকতালীয়ভাবে তাঁর বাড়িও ছিল বীরসিংহ গ্রামে।

 

 

কার্মাটাঁড়ের পুরোনো বাড়ির ছবি

 

 

স্টেশন থেকে অদূরে একটা অশ্বত্থ গাছ দেখিয়ে বলে দেন ওর পিছনেই নন্দনকানন। সেদিকে যেতে যেতে একটা চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করাতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ বললেন,‘ঈশ্বরচন্দ্র দেওতা?’ পাটনা থেকে আগত দু-জনেই প্রথমবার শ্রদ্ধাসূচক এই স্থানীয় শব্দটার সম্মুখীন হলেন। পরে জেনেছিলেন, বিদ্যাসাগর ওই অঞ্চলে এক দেবতা হিসেবেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। গুরুচরণ সামন্ত এবং নরেন মুখার্জি নন্দনকাননের বাস্তবিক অবস্থান, পরিস্থিতি, মালিকের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি তো সন্ধান করেনই, তার সঙ্গে আরও কিছু কাজও করে রাখেন।

 

জামতাড়ায় তাঁরা বাঙালি সমিতির একটি ব্রাঞ্চ গঠন করেন এবং তাদের মধ্যে থেকেই নন্দনকাননের খোঁজখবর রাখার জন্য একটা তদর্থক সমিতি গঠন করেন।তাঁরা মিহিজামের ডাক্তার পরিমল ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করে তাঁরও সহযোগিতার আশ্বাস পান। স্মৃতিরক্ষা কমিটি নিজেদের মতো করে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিহার সরকার যাতে সম্পত্তিটি অধিগ্রহণ করে জাতীয় স্মারকে রূপান্তরিত করে,  সেই চেষ্টাও করতে থাকে। এইমর্মে ২৮/১/১৯৭৩ তারিখে কর্মাটাঁড় ও জামতাড়ার বিশিষ্ট ২৮জন ব্যক্তির (যাঁদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারাও ছিলেন) স্বাক্ষর-সহ একটি চিঠি বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া হয়।এতে হয়তো একটা লাভ হয়েছিল।পরে ওই সম্পত্তি কেনার সময় বিহার সরকারের অর্থ সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল।

 

 

আরও পড়ুন

বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ হতাশ করে বললেন, ‘বল কী, তাহলে তো বঙ্কিমের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল

 

 

১৪ নভেম্বর ১৯৭৬ তারিখে বিদ্যাসাগর প্রকল্পের উদ্‌বোধন হয়। সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের পর তার দখল নেওয়া, ১১কামরার মূল বাসভবনটিকে যথাযথ করে তোলা, বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত জিনিসপত্র যা বেঁচে ছিল সে সব হেপাজতে নেওয়া, তারপর শিক্ষামন্ত্রী এবং অন্যান্য ভিআইপিদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া, এ সবে কিছুটা সময়ও গেছে। এর আগে ১৯৭৪-এর এপ্রিল মাসে মুখ্যমন্ত্রী আবদুল গফুরে রবিদ্যাসাগর প্রকল্প উদ্‌বোধন করার কথা ছিল।খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল। কিন্তু মনে হয় যেতে পারেননি। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ মিশ্রও কর্মাটাঁড় পরিদর্শনে যেতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও মনে হয় যাননি, কেননা কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।

 

১৯৩৮ সালে বিহারের প্রবাসী ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা তৈরি করেন এই সংস্থা

 

তাহলে পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য একটু দেখে নেওয়া যাক। তিনি জানাচ্ছেন—“কর্মাটার।পথের দুধারে লোক দাঁড়িয়ে। বিদ্যাসাগরের বাড়ি ‘নন্দনকানন’ লোকে লোকারণ্য।দেখলাম বাড়িতে যাবার যে পথ একদা জবরদখল হয়েছিল, তা এখন মুক্ত। … ঢুকলাম নন্দনকাননে।আগাছাগুলি নেই। আবর্জনার স্তূপ অন্তর্হিত। স্থানটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।কর্মাটারের রেলকর্মীরা এবং স্টেশনমাস্টার সবাই মিলে এই দুরূহ কাজটা সম্পন্ন করেছেন।স্থানীয় ছেলেরা ব্যাজ বুকে সারাক্ষণ খাটছেন। পুরোনো বাড়িটা মেরামত করা হয়েছে।নতুন পলেস্তারা  লাগেনো হয়েছে। অপহৃত জানালা দরজাগুলি অবশ্য এখনও লাগানো হয়নি।”

 

সেদিনের সেই প্রকল্প উদ্‌বোধনে যেসব বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল, নন্দনকাননে (১) বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন, (২) পানীয় জলের ব্যবস্থা, (৩) হোমিয়োপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন এবং (৪) জামতাড়ায় সাক্ষরতা কেন্দ্রের উদ্‌বোধন। বলে রাখা দরকার, বিহারে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজ এই সাক্ষরতা কেন্দ্র দিয়েই শুরু হয়।গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে এসেছিলেন বিহারের শিক্ষামন্ত্রী রামরাজ প্রসাদ সিং, বিধানসভার স্পিকার পণ্ডিত হরিনাথ মিশ্র এবং স্মৃতিরক্ষা কমিটির সভাপতি বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও আরও অনেকে।এই বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাইনে জোগাড়ের কাজে স্মৃতিরক্ষা কমিটিকে বছরের পর বছর প্রভূত সাহায্য করেছিল পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বকোষ পরিষদ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি এবং আরও কয়েকটি সংস্থা।

 

রেলস্টেশনের নাম বদলের চেষ্টা ১৯৭৪ থেকেই চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। চিঠির পাহাড় জমে উঠছিল। সরকারি স্তরে ব্যাপারটা নিয়ে তদবির-তদারক করার অনেক গল্প আছে।সে সময় ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বেহার হেরাল্ড’ বাঙালি সমিতির তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বেশ জনপ্রিয় কাগজ ছিল। কাজেই যাকে বলে মিডিয়া ফোকাস, সেটা ভালোভাবে দেওয়া যাচ্ছিল।অবশেষে ফল পাওয়া গেল রেলমন্ত্রী মধু দণ্ডবতের আমলে।বাঙালি সমিতির আবেদন এবং বিহার সরকারের শংসায় রেলমন্ত্রক স্টেশনের নামটা কর্মাটারের বদলে ‘বিদ্যাসাগর’ করে ১৯৭৮সালে।

 

 

 

১৯৮০ থেকে ১৯৯২ অবধি নন্দনকাননে বিশেষ নতুন কিছু হয়নি।বালিকা বিদ্যালয় চলতে থাকে, হোমিয়োপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রও চলতে থাকে। কার্তিক মণ্ডল রক্ষণাবেক্ষণের কাজে থাকেন। কিন্তু টাকার অভাব একটা বিরাট সমস্যা হয়ে ওঠে।সরকারের স্বীকৃতিতে অর্থ সাহায্যের কোনো কথা ছিল না। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাইনে দেওয়া, দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য ওষুধ সংগ্রহ করা এক কঠিন দায় হয়ে ওঠে।কিছু কলকাতা থেকে আসা সাহায্য, কিছু পাটনায় চাঁদা করে অথবা সমিতির কিছুটা স্বচ্ছল কর্ণধারদের ব্যক্তিগত দানে মাইনের টাকাটা কুলিয়ে ওঠে না। তবু যেমন করেই হোক, বিদ্যালয়টা চলতে থাকে।

 

আরেকটি সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয়। চারদিকে ইংরেজিমাধ্যম  স্কুলের প্রাধান্যের ফলে বিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যাও বাড়ে না। বরং কমতে থাকে। আরও কিছু সমস্যা হতে থাকে। যেমন,স্মৃতিরক্ষা কমিটি ও বাঙালিস মিতির প্রধান নেতৃবৃন্দের বয়োবৃদ্ধি এবং নতুন উৎসাহীকর্মীর অভাব। সেই একই সমস্যার সম্মুখীন সমিতির জামতাড়া শাখা বা স্মৃতিরক্ষা কমিটির জামতাড়াবাসী নেতৃবৃন্দকেও হতে হয়।

 

 

আরও পড়ুন

প্রায় বছর খানেক যে-মনীষীর সঙ্গলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল- যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়

 

 

১৯৯৩ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর (অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে) কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের একটি মর্মরমূর্তি স্থাপন করা হয়। মূর্তি দান করেছিলেন পাটনার বিখ্যাত জনদরদি আইনজীবী এবং বার অ্যাসোসিয়েশনের অধ্যক্ষ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। উন্মোচন করেন পাটনা উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি বিমলচন্দ্র বসাক। এ প্রসঙ্গে পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিবরণে (হিন্দুস্তান টাইমস ৩/১০/১৯৯৩ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ) দেখা যাচ্ছে–

 

 

 

 

“It was the morning of September 26. The sky was overcast and it had been raining since dawn. At about 9 O’clock the rain stopped. The crowd had been increasing steadily. One could see the century-old house–NandanKanan– surrounded by extensive grounds. A well decorated stage had been erected to the left of the house where a marble statue was covered with a piece of red cloth. The backdrop of the stage proclaimed ‘VidyasagarJanmotsav, Bihar Bengalee Association’. …

 

“Justice Bimal Chandra Basak dwelt on the relevance of the concept of justice in the context of modern life and said that Vidyasagar had realized that only mass-education could lead to social justice.

 

“The artistes of Jamtara presented a cultural programme after which crowds of tribal men and women dressed in their best attire offered floral tributes to the statue – a sight enough to send a thrill down the spine and bring tears to the eyes. Vidyasagar is a god of action– ‘Karamdevata’– to them. They have been worshipping for generations the cemented dais marking the spot where Vidyasagar sat every day.”

 

 

১৯৯৪-এর সেপ্টেম্বর মাস থেকে বিদ্যালয়টির ব্যয়ভার পুরোপুরি কলকাতার বিশ্বকোষ পরিষদ ওঠাতে শুরু করে। সে বছরই বিশ্বকোষ পরিষদ এবং ‘পথের পাঁচালী’ নামের একটি সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায়, দেড় লক্ষ টাকায় নন্দনকানন পরিসরে ‘ভগবতী ভবন’ নামেএকটি ভবন নির্মিত হয়। ২০০০ সালে বিহারের বিভাজনের পর ঝাড়খণ্ড জেলা তৈরি হল। পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন হল। সাধারণ বাঙালি মানসেও তার একটা প্রতিকূল প্রভাব পড়ল।

 

বিভক্ত বিহারের বাঙালি তার প্রান্তিক অবস্থা থেকে বেরোবার চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে বাঙালি অধ্যুষিত হয়েও আদিবাসী অস্মিতার রাজ্য ঝাড়খণ্ডে বাঙালি নিজের সঠিক অবস্থানটা নিতে দ্বিধা করল। তার সুযোগও নিল সরকার।দ্বিতীয় রাজ ভাষার লড়াইয়ে এক সঙ্গে ১১টা দ্বিতীয় রাজ ভাষায় বাংলাকে ঢুকিয়ে দিল, প্রধান রাজ ভাষা করে দিল হিন্দি।এই সময় ঝাড়খণ্ডের ‘বিহার বাঙালি সমিতি’র বা তখনও অগঠিত ‘ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি’র পুরোনো একটি শাখার অবদান অনস্বীকার্য। সেটি হল জামশেদপুর শাখা।দ্বিধা দ্বন্দ্বে সময় ব্যয় না করে তাঁরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলেন ‘বিদ্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয়ে’র সহায়তায়। তারপর থেকে কলকাতা আর কিছুটা পাটনা ছাড়া তাদেরই সাহায্যে স্কুলটি চলতে লাগল।

 

২০১১ সাল থেকে নতুনভাবে  উজ্জীবিত ‘বিহার বাঙালি সমিতি’ কিছুটা কৌশলী হয়ে নন্দনকাননে ‘গুরুদক্ষিণা’ কার্যক্রম করার মতো একটা রণনীতিক সিদ্ধান্ত নেয়। বিদ্যাসাগর আমাদের ভাষা গুরু, তাঁর পায়ে ফুল দিতে যাব। ‘রণনীতিক’ বলছি এইজন্য যে নতুন পরিস্থিতিতে, একদিনের ছোট্টো‘ তীর্থ দর্শন ও পর্যটন’ প্যাকেজের আকর্ষণ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল।পাটনা, কলকাতা, জামশেদপুর, রাঁচি, ধানবাদ, বোকারো থেকে একদিন এবং বিহারের অন্যান্য জেলা—ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, বেতিয়া, পূর্ণিয়া, কাটিহার থেকেও তেমন, এমনকী শিলিগুড়ি বা দিল্লি থেকেও আসা শুরু করেছিল।শিল্পীদের দল যেচে এসে অনুষ্ঠান করে যায়।

 

তারই সঙ্গে সমিতির চেষ্টায় অতিথিশালা, আহারের ব্যবস্থা ছাড়াও কাছেপিঠের দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। প্রথমেদিন নির্দিষ্ট ছিল না, বছরের যে কোনোদিন আয়োজন করা  হত। কিন্তু দিন এখন নির্দিষ্ট  হয়ে গেছে—২৯ মার্চ সমিতির মালিকানায় আসার দিন, বিদ্যাসাগরের জন্মদিন ২৬ সেপ্টেম্বর এবং তিরোধানের দিন ৩০ জুলাইয়েও কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

 

 

 

‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি রক্ষা সমিতি’ নতুন করে তৈরি হয়ে পঞ্জীকৃতও হয়েছে। স্মৃতিরক্ষা সমিতির নতুন নেতৃত্বে এমন মানুষ পাওয়া গেছে যাঁরা উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিচক্ষণ ও একনিষ্ঠ। ওই তিনদিন ছাড়াও তাঁরা প্রায় প্রতি মাসেই জায়গাটির পরিদর্শনে যান। তাঁদেরই চেষ্টায় এবং অনেক মানুষের আর্থিক সাহায্যে আজ নন্দনকাননের চারদিকে উঁচু পাঁচিল দেওয়া গেছে, অন্য দিক দিয়েগাড়ি নিয়ে ঢোকার মতো গেটও তৈরি হয়েছে। নন্দনকানন এখন কোনোরকম অনুপ্রবেশ থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।

 

আরও পড়ুন

২০০ বছরে বিদ্যাসাগর: ফিরে দেখায় মাইকেল মধুসূদন

 

 

২০১৭-র ‘গুরুদক্ষিণা’র কিছু আগে থেকেই ঝাড়খণ্ডের সরকারি মহলে কিছু নড়াচড়া টের পাওয়া যায়। তার কিছু দিন আগে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী জামশেদপুরে ঘোষণা করেন নন্দনকাননকে ‘ঐতিহ্য ক্ষেত্র’ করার চেষ্টা করবেন তিনি। ১৫ মে, ২০১৬-র‘ বিহার হেরাল্ড’এর পাতায় দু-টি খবর পাশাপাশি ছাপা হয়।

 

“…the block-cum-circle office of Karmatand has submitted a DPR for one crore and fourteen lakh rupees to develop NandanKanan as a heritage site and develop it from the aspect of tourism.
District administration has also sent a proposal to the state tourism department. This may well be reminded that Chief Minister of Jharkhand had also given a nod to the proposal of declaring NandanKanan as a heritage site.”

 

 

কিন্তু দু:খের কথা, প্রায় ৩০ বছর সগৌরবে চলার পর সরকারি আনুকুল্য ও অর্থের অভাবে ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে যায় স্কুলটি। বিদ্যাসাগরের স্মৃতি আঁকড়ে থাকা কর্মাটাঁড় আজও অবহেলিত। মনীষীর জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তিতেও নেই তেমন কোনো বড়ো উদ্যোগ। ঈশ্বরচন্দ্রের স্মৃতিরক্ষার সঙ্গে তাঁর ভাবনা রূপায়ণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ‘বিহার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন’। কিন্তু অর্থের অভাবে বাধা প্রতিপদে।

 

অর্থাভাবে বালিকা বিদ্যালয় ও বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গিয়েছে।তবে হোমিয়োপ্যাথি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রটি আজও চালিয়ে যাচ্ছে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা সমিতি’। তাঁর মতাদর্শে স্বনির্ভর মহিলা সমাজ গড়ে তুলতে নন্দনকাননে খোলা হয়েছে মহিলা সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রায় ৪০জন মহিলা সেলাই শেখেন।আরও অন্যান্য প্রকল্প চালু হওয়ার কথা ছিল,সেসব আজও পরিকল্পনার স্তরেই আটকে আছে।

 

 

নন্দনকানন উদ্‌যাপন কমিটির লক্ষ্য হল,নন্দনকাননকে ‘ভাষাতীর্থ’ হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা। সরকারের নজরে নিয়ে আসা, যাতে অর্থের জোগান নিয়মিত হতে পারে। তাহলেই বালিকা বিদ্যালয়, বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র, কৌশল-বিকাশ কেন্দ্র, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র,স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রভৃতি যত রকমের পরিকল্পনা আছে, সব ক-টি সুষ্ঠুভাবে শুরু করা যায় এবং চালানো যায়। নইলে শুধু বছরের ওই একদিনের হুজুগ ছাড়া কিছু হবে না।‘বিহার বাঙালি সমিতি’ এবং ‘ঝাড়খণ্ড বাঙালি সমিতি’ এই কাজেই মনোযোগী এখন।

 

i

আরও পড়ুন

২০০ বছরে বিদ্যাসাগর: ফিরে দেখায় মাইকেল মধুসূদন

 

 

ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মস্থান বীরসিংহ বাঙালির আবেগে জায়গা করে নিলেও, কর্মাটাঁড় আজও অবহেলিত। কিন্তু ‘নন্দনকানন’ও বাঙালির তীর্থ হয়ে উঠতে পারত। তার দাবিও কোনো অংশে কম নয়। শিমুলতলা, দেওঘরের পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের ‘নন্দনকানন’ নিয়েও গড়ে ঊঠুক না পর্যটন ক্ষেত্র। তখনই হয়তো মহাজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঋণ পরিশোধে কয়েক পা এগোনো যাবে।

 

 

তথ্যঋণ:
>ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— কর্মাটাঁড় প্রবাস প্রসঙ্গ/ বন্দনা রায়
>কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর / ড.প্রশান্তকুমার মল্লিক
>বিদ্যাসাগর রচনাবলী
>ব্লগ গণদাবী–‘কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর’
>এইসময় (দৈনিকপত্র)
>আনন্দবাজারপত্রিকা ডিজিটাল

>India times
> The Sangbad
>Gatebengal.com
>Dhanbad india blog spot
>Hindustan Times

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
19FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!