২০ এপ্রিল, ২০২৪শনিবার

২০ এপ্রিল, ২০২৪শনিবার

জন্মদিনের স্মরণিকা, নির্বাচিত পার্থলেখ: ১৯৬৯-২০১২

 কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৯- ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)-এর আজ জন্মদিন। প্রায় মাস তিনেক হতে চলল প্রয়াত হয়েছেন। আমাদের বিনম্র স্মরণে আজকের দিনটিতে তাঁরই কবিতা, গদ্য আর অনূদিত রচনায় সমৃদ্ধ হল ‘বইপাড়া’ বিভাগটি। এর আগে, ৩০ নভেম্বরে ‘ফিরে দেখা’ বিভাগে বর্ষীয়ান দুই কবি শঙ্খ ঘোষ এবং সম্প্রতি প্রয়াত অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পর্কে তাঁর একটি নিবন্ধ আমরা পাঠকের কাছে হাজির করেছিলাম। আজকের নির্বাচনেও তাঁর গ্রন্থবহির্ভূত রচনাই রইল। বিভিন্ন পত্রিকা এবং সম্পাদিত সংকলন সূত্রে এগুলি গৃহীত। আগের মতোই সংগ্রহ, নির্বাচন ও তথ্যসূত্র সম্পাদন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রচনাগুলির বানান অবিকৃতই আছে, সাম্প্রতিক রীতি অনুযায়ী কোনো সংস্কার এবং সমতা রক্ষা করা হয়নি।

 

কবিতা
প্রত্যাশাহীন
আমার প্রত্যাশা ঠিক নক্ষত্রের মতো হলো দীপ্যমান দূর,
নিজেও সমুদ্র নই প্রত্যাশা চেয়েছি আমি— গণ্ডূষের পাত্র যাতে ভরে
অথচ প্রত্যাশা হলো সমুদ্রের অন্তহীন ফেনা।
কতোকাল এই ভাবে বাঁচা যায়? একা সন্ন্যাসীর পায়ের দুপাশে
শীতার্ত পাথর রাক্ষসের মতো হেসে ওঠে, সমস্ত পথের পরে হাঁটা
এখনো হলো না, পথ আত্মপ্রবঞ্চনা করে হিমবাহে সহসাই
সোনার মেঘের দল দু’একটি পর্বতের শীর্ষে রেখে যায়
একারণ বিশ্রামের যাত্রীবাসে মাঝরাতে তস্করের মতো ধীরে,
                                                       চোখ জেগে ওঠে,
উপত্যকা প্রলম্বিত, ভ্রূমধ্য নাসিকা তার পাশে হয় ভূমধ্যসাগর,
আমি ঠিক তখনো ঘুমিয়ে, পদ্মের পাতার মতো নিজেকে স্থাপিত করে
                                                      করোটি ভিতরে
আমাকে দেখালো সেই, দীর্ঘতার মধ্যে ছিন্ন দুটি প্রত্যাশার নাম,
                                                         জন্ম ও মৃত্যুর
মতো দুটি ভিন্ন পথ, দুটি মিশে যাওয়া পথ হয়ে
দুই পদ, পদতল, পড়ে আছে পায়ের ওপরে।
পথ ছিলো দুই পদ, এখন সে শনিচোখ
ছিন্ন করে দেয় পদপদ্ম, চতুর্দিকে যাত্রীর নিবাস—
                                                 আজীবন গঙ্গাতীরে—
শ্মশান ও ধুলালিপ্ত ফুল বুকে করে
আজীবন জ্বলে উঠি,
নিজের চিতায় শুধু কলসের জল ঢালা বাকি থেকে গেলো।
                                                         [কবিতার পুরুষ, ১৯৬৯]

 

যাদু
ফুরিয়ে যাবে হে
তোমার এ রোস্‌নি, জৌলুশ, জমানা থাকবে না
হেসে উঠল নীল পোশাকের কিন্নর
ঘুরতে থাকল বর্ণভ্রমে বর্ণভঙ্গের মতন নর্তকী।
          সত্যিই
         ফুরিয়ে যায়
         একদিন উপলব্ধি মরে গিয়ে শব্দেরা খেলনা
         একদিন আকর্ষণ চলে গেলে বেঁচে থাকা অর্থহীন ছবি
তালে তাল দাও
জমজমাট মেহ্‌ফিল নেশায় দুরস্ত্‌, দুরন্ত ছুটছে
এতো রঙ, তবু রাত
এতো রঙ্গ, হৃদয়ে তবুও পক্ষাঘাত
এতো তাপ, বাইরে মৃত্যুর মতো শীত।
            পদাঘাত বেজে উঠল সেসময় সেই সুসময়ে
            ফুরিয়ে যাবে হে
            ওই রোস্‌নি, জলুশ মেহফিলের বদলে
            বুকে কেন ছুরি বসাবে না?
আঃ, দাঁতে ধার, নখে বিষ, নখে নীল বিষ
নীল চাঁদ আয়ুর মতন উড়ে যায়
হা হা ফেটে পড়ে মদ আর মদের মতন অনুভব
এতো সুখের সংসারে এতো দুঃখের সংসারে আসরে
কচ্ছপটা চলে এলো, লাথি মারলে ঢুকে যাচ্ছে খোলসের ভিতরে
খুব সাবধান,কামড়ে ধরতে পারে সুখ আর দুঃখের টুঁটি
                                                                  [গল্পকবিতা, শারদ সংখ্যা ১৯৭০]

আরও পড়ুন
পাঠকের ব্যক্তিগত: শঙ্খ এবং অলোকরঞ্জনের কবিতা প্রসঙ্গে পার্থপ্রতিম

ছবি সৌজন্যে: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

সে
মনুষ্যত্ব যখন প্রাণিতার পাথরে আবদ্ধ ছিল এমন এক সময়ে এক রমণীর বৃদ্ধা হইবার ভাগ্য ঘটিয়াছিল। সেই নিখিল নিষ্করুণতার মধ্যে সে সামান্য কিছু অক্ষর লইয়া পাগল হইয়া থাকিত। লক্ষ করিত, সেই উন্মাদনার কারণেই সে বাঁচিয়া আছে এবং অন্যান্য প্রতিবেশীও তাহাকে কৌতূহলে ও করুণায় বাঁচাইতেছে। গোপনে, সে অনন্তকে চাহিত।
সে মরিলে অন্যান্য মানুষের স্মৃতিতে তাহার জীবনের এই দুর্বোধ্যতা থাকিয়া যায়। এই সকল স্মৃতিসমবায় ও ইথারে আবদ্ধ সেই বৃদ্ধার উচ্চারণ হইতে কবিতা জন্মগ্রহণ করেন। জন্মিয়াই তিনি বৃদ্ধা, স্বর্ণরথাসীনা, কাকসকল তাঁহার সঙ্গী। তিনি ক্ষুৎকাতর এবং সেই ক্ষুধা, অনন্তের। তিনি সকলই খাইয়া ফেলিলেন। সুতরাং মানুষ ও চরাচরের পূর্ণজ্ঞানের সূত্রটি খোয়া গেলো। ইহা দেখিয়া কবিতা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষমতাসীনেরা তাঁহার স্তব করিয়া জানান যে ইহাতে সর্বপ্রকার আকাশ ও নিরাকাশ নষ্ট হইবে, সুতরাং কবিতা যেন ক্ষমতাশীলা হইয়া নিজেকেই আহার করেন, তাহা হইলে তিনি অনন্তযৌবন ও উত্তরোত্তর উৎকৃষ্ট যৌবন পাইবেন এবং তাঁহার সর্বাহার ইহাতেই সূক্ষ্মভাবে ঘটিবে। বৃদ্ধার প্রেতিনী, ইহাতে, কাশফুলের নিকট নাতি লইয়া বসিয়া থাকা ঠাকুমার ন্যায়, খুশি হইল এবং এই প্রস্তাব গ্রহণ করিল। সেই অবধি কবিতা ছিন্নমস্তা,— শিবরাম চক্রবর্তী-ও ইহা লক্ষ করিয়াছেন— শুধু তিনি বলিয়া যান নাই যে এই বাস্তবতার সহিত আরো দুটি বাস্তবতা আছে, যাহা ছিন্নমস্তার দুই পার্শ্ববর্তিনী রক্তপানরত যোগিনী, যাহা গদ্য ও পদ্য।
                                                                                        [সংবর্ত: ২, সেপ্টেম্বর ১৯৮৪]

নিমতলার অনঙ্গ
এই গলিতে আয় রে কামা এই গলিতে আয়
লোচা বাচা দেবো তোকে, এই গলিতে আয়
আরে হ্যাঁ লোচা বাচা, যাকে লোকে লোচ্চা বলে—
বাচ্চা তো হতেই হবে, তাকে দেবো ভাঙ্‌ভুজ্‌না
ভাঙ্‌ সে ভালই খাবে, তোর মতো গাঁওবুঝ্‌ না
সে জানে শরীর থলি, থলি আজ চললো গলি—
এই থলিতে আয় রে কামা এই থলিতে আয়
ভাঙ্‌ভুজ্‌না তোকেও দেবো এই থলিতে আয়।

এই গলিতে যায় রে বামা, এই গলিতে আয়

গলিশেষের পথ পড়েছে ঘাটের গঙ্গায়
গঙ্গা শূন্যপুরাণ, বহু মড়া হোথায় জুড়ান
তুই তো জুড়োবি না, পুণ্যও কুড়োবি না
ও কামা, বলবি তোকে কোন্‌ কলিতে খায়!
এই গলিতে আয় রে কামা, এই গলিতে আয়
আরে হ্যাঁ, লাশ পড়েছে, লাশে পড়ে চাদরমুড়ি
একটু বাদেই এ-ভাঙ্‌ খাবে ঐ গঙ্গাবুড়ি

মড়াটা দ্যাখাচ্ছে দ্যাখ, আর একটা লোচাবাচা

নাগরিক কমিটি আছে, নইলে যেতই নাচা— 
কী করিস? গাঙের লাশে তোর কেন ঠেকেছে দায়?
ঘাটে আমি দাঁড়িয়ে আছি, ও নয়, আমি-ই বলি,
কোনোদিন পথ পাই না এমনই মজার গলি—
তাছাড়াও থেকে তো গেল তলপেট নিচুর নলী!
পাই বা না পাই তাকে, আমাকে সে সর্বদা পায়—
এই নলীতে আয় রে কামা এই গলিতে আয়
বাচা ভাঙ্‌ভুজ্‌না দেবো, এই থলিতে আয়।
                                              [মাঝি, নির্বাচিত কবিতা ১৯৮৯-৯২]

ছবি সৌজন্যে: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

আরও পড়ুন
ভাইফোঁটা: যমের বিরুদ্ধে বাঙালি বোনেদের চ্যালেঞ্জ

নি র্বা চি ত  গ দ্য লে খ: ১
নোবেল-না-পাওয়া রবীন্দ্রনাথ (যখন চিৎপুরে থাকতেন) এদিক-ওদিক ঘুরে ছিন্নপত্র লিখতে লিখতে বলেছিলেন যে বাক্‌ক্ষেপণের সংগীতময়তা জিনিসটে নির্ণয় করা অসাধ্য, অথচ ওইটা না থাকলে কবিতা পুঞ্জিত উপকরণ মাত্র হয়ে ওঠে, স্ফুলিঙ্গ-অভাবে আগুন হয়ে উঠতে পারে না। স্বরসঙ্গতি ও বিস্তার ছাড়াও, কবিতার এই সাংগীতিকতায় যা লাগে তা হচ্ছে মুখের ভাষা—  মুখের কথ্য ভাষা না হলেও, তার ভঙ্গি ও ধরণধারণের উঠে আসা। এইটেই একমাত্র শর্ত নয়; স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সব কটি পদ্যাকার লেখা এই শর্তে আক্রান্ত কিন্তু সবাই যে কবিতা নয় তা আমরা যারা রবীন্দ্রনাথের খ্যাতিট্যাতির কারণে সাফার করি না রবীন্দ্রপ্রেমিক বা রবীন্দ্রবিরোধী বনে গিয়ে, ভালোরকম জানি। কারণ, সেইসব লেখায় ছিলো না সত্তার অলক্ষ্য ইথারপ্রতিম নিরঞ্জনত্ব, যাকে সামগ্রিকতা বা entirety বললে ভুল হবে না। সেইসব লেখা কখনো মাত্র আবেগপ্রবণ হয়েছে, কখনো মেধাবীমাত্র হয়েছে। কবিদের, দেশজ ভাষা ছাড়া অন্য কোন শিকড় থাকলে চলে না এবং কবি হতে চাওয়াটা একটা শিকড়। বিংশশতাব্দীর শেষদিকে বেশ কিছু বাঙালি কবি ছাড়া মোটামুটি এই হলো বহুজনের কবিতার ইতিহাস।…
     [প্রতিবিম্ব, ১৯৭৯; সূত্র: স্বরাজ সিংহ এবং বিজন মুখোপাধ্যায়ের কবিতাপুস্তিকা সম্পর্কে আলোচনা। ]

 

নি র্বা চি ত গ দ্য লে খ: ২
আসলে, এখন যেমন সামন্ততান্ত্রিক তথা বণিক পরিবারের মতো একটি কি দুটি কি পঁচাত্তরটি পরিবার পৃথিবীতে বাঁচতে আসেনি— কবিতার পৃথিবীতেও তেমন ঐ শতাব্দীতে অঙ্গুলিমেয় কবিদের দিন চলে গেছে, বদলে ক্রমশই আসছে এক মহাসাধারণ যাদের এমন কোনো কূটনৈতিক পরামর্শদাতা, বিধায়ক ও শাস্তা হতে পারে না যিনি বলে-টলে দিতে পারবেন যে অমুক কারণে তোমরা উন্নতি করিতে পারিলে না এবং ইহারা করিল! আমি মানছি যে এখনো আমাদের দেশ অনেকটাই গড়িয়া-বাগনানের মতো বলে এখানে ‘জনপ্রিয়’ কবি হয়, যাঁদের আবৃত্তি বা লেখালেখি বেশ গ্ল্যামারাস। তরুণরাও পপুলার-পোয়েট বা পো-পো হতে চান। কিন্তু আমরা অনেকেই জেনে গেছি যে Glamour, in the final analysis, is but an artful dodger of the truth, concocted to disguise reality. It only blocks the way to deepest intimacy.। যদিও একটা কথা বলা দরকার, আমরা যারা এটা জানি তারাও যে এই গ্ল্যামারসম্পাদনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত তা নয়।…

   যাহোক, গোড়ার প্রসঙ্গে আসি। এখন কি তাহলে ধরে নিতে হবে যে যা লিখছেন সবই কবিতা? তা কখনই নয়। জীবনানন্দের সেই ‘বিশেষ’ শব্দটি মনে পড়ে? শুধু বিশেষ ব’লে, অন্যমনস্ক থাকার সুবিধে নিয়েছিলেন তিনি। আমার চোখে এই বিশেষ-এর অনুবাদ হলো আত্ম-কৌতুক, যার অভাবে প্রাচীনতা এসে পড়ে। যে আত্মকৌতুক সত্যেন্দ্র দত্ত, সুকান্ত, নজরুল— এঁদের ছিল না এমন নির্দেশ করা যায়। এ থাকলেই আমরা বলতে পারি ইনি লেখেন, না থাকলে, লেখেন না। পশ্চিমবাংলায় যাঁরা লিখছেন, তাঁদের অনেকেরই— সব মিলিয়ে চল্লিশোর্ধ্ব সংখ্যা হবে এমন লেখকদের, আত্মকৌতুক আছে।…

[অভিমান: ১১, মার্চ ১৯৮২; সূত্র: ‘সুতপা সেনগুপ্তকে সুরভিলতা নিয়ে একটি চিঠি’ শীর্ষকে মুদ্রিত। গৌতম চৌধুরীর ‘হননমেরু’ প্রসঙ্গে আলোচনার অনুরোধ করা হয়েছিল, লিখতে রাজি হননি, কিন্তু দেবকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সুরভিলতা’ সম্পর্কে লিখতে কেন রাজি হন, তার বিশদ কৈফিয়ত দিয়ে চিঠিটি লিখেছিলেন। চিঠিতে ইংরাজি অংশটি শিশু ও সন্তানপালন বিষয়ক কোনো গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত। দীর্ঘদিন আগে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্নের উত্তরে তাঁকে জানিয়েছিলেন লেখক।]

আরও পড়ুন
এখানকার কালীপূজা হিন্দুদের যতটা মুসলমানদেরও ততটা

ছবি সৌজন্যে: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

নি র্বা চি ত গ দ্য লে খ: ৩
একটু বলে নিই যে কবিতার কাছে বাঙালির মন কী কী দাবি করে। পাঁচালি ও ক্যান্টো এই মনকে শাসন করে, ‘বামপন্থা’ করে, প্রয়োজনীয় ফ্যাশনও করে, কিন্তু সবথেকে বেশি শাসন করে বাবুয়ানি। আমি বিদ্রূপ করছি না, অবস্থার বর্ণনা করছি মাত্র, দৃষ্টান্ত, একই সঙ্গে জিন্‌স ও রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একযোগী উত্থান। সুতরাং পয়ার, (১৮ বা ২২) নির্দিষ্ট মাপের স্তবকবন্ধ এবং কবিতা তথা কবির উচ্চারণে (অর্থাৎ একটি লেখা পড়তে পড়তে যে উচ্চারণভঙ্গি রয়েছে মনে হয়— কবির নশ্বর উচ্চারণ নয়) হয় বামপন্থী স্বর বা বাবু-স্বর বা বামপন্থী বাবুয়ানিই বাঙালি পাঠকের সাধারণভাবে পছন্দ হয়।…
…কবিতার ত্রিসত্য যদি হয় অনন্ত, সৌন্দর্য এবং আনন্দ তবে এই সমীকরণে আশা করা যায় যে একজন কবির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে শিল্পীর অংশ, যে শিল্পী পাঠকের প্রতি সতর্কচোখ। যে পাঠক আজ বাংলা কবিতা পড়েন, macabre রস, বিষপানরত শিবশ্রী তাঁকে আর আজ তৃপ্ত দিতে পারে না। কারণ প্রত্যেকদিনের খবরের কাগজ, লোকাচার, ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে বাধ্য করছে প্রসাদময়ী শিল্পের নন্দনে— যেসব শিল্পের অন্তর্দেশে একটি স্থায়ী সুবাতাস আছে সেইসব শিল্পের আকর্ষণই তাঁর কাছে বেশি। এটা হতো না। হয়েছে এই জন্যে যে বীভৎস রৌদ্র ভয়ানক প্রভৃতি রস নিয়ে কিছু trick করা এখনকার এক চালু অশিষ্টতা যাতে অনেকে অভ্যস্ত, যেমন Jaws দেখা! এইসব ফিলমে হাঙরের চিরঅনিদ্রা, উদ্বাস্তুতা এবং একই সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে উৎপাদিত অজস্র প্রাণশক্তি— যা আসল ভয়— তার সঙ্গে পরিচয় হয় না, হ’লে এতো দর্শক Jaws নাও দেখতে পারতেন।…
[অভিমান: ২৪, ১৯৮৫; সূত্র: ‘চন্দ্রহীন ঘনাবলী’ শীর্ষকে সুবোধ সরকারের ‘ঋক্ষমেষকথা’ কেন্দ্র করে আলোচনা।]


আরও পড়ুন
ফিরে দেখা: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়ানে জোড়াসাঁকোর দুর্গাপুজোর স্মৃতি

ছবি সৌজন্যে: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

নি র্বা চি ত গ দ্য লে খ: ৪
…জীবনানন্দের কেন আরও অনেকের সৌভাগ্য যে ১৯৫৪তে, একটা ট্রাম, তাঁকে, এখনকার ভাষায়, রিয়্যাল লাইফ-স্টোরি করে তোলে। এর বছর-সাত আগে তেরঙ্গাঝান্ডার স্বাধীনতা লালপতাকার নানাবিধে— অন্তত প্রাচীন বারুণী নতুন আধারে গেলে যেটুকু শব্দের ফেরতা নতুন কুলিধরতাই-এর উদ্বেজনা বিষয়ীমনকেও কিছু পাখসাট মারে, সেই সময় চলছে তখন; মানে তখনও প্রেসিডেন্সির রেলিঙে ইতিহাস বইকাগজের আপেলগন্ধী ধূসরতায় সম্ভ্রান্ত, স্কটিশের সামনের রাস্তা উজ্জ্বল রোমান্টিকে ছাওয়া, সিনেট হলের থাম সুগোল— দেশপ্রিয় পার্ক দেশবন্ধু পার্ক হেদুয়া কলেজ স্কোয়ার প্রভৃতি অঞ্চলে মধ্যাহ্নশেষ থেকেই তখন জীবনানন্দের কোনও-কোনও শব্দাবয়ব ও ভাষাচালের অতিশয় কাছাকাছি যাওয়া যেত— আমরা, ডেঁপো বালকেরা, যাদের পিতৃকুল প্রেসবিজড়িত ছিলেন বলে, পদ্যপ্রাণ উত্তর কলকাতার বাসিন্দায় ‘জীবনানন্দ বুঝি না’ শুনে হয়তো অতি সকালে, প্যারোডি করা যাবে ভেবে পড়তে গিয়ে সর্বস্বে সিন্ধূপম এই সুলিপিমনীষার কবলে পড়ে গিয়েছিলুম, ৫৮ থেকে এ-জিনিস প্রায় ৭০ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেছি। কোনও সন্দেহ নেই যে, প্রধানত সভাকবিতা অর্থাৎ পদ্যে-নিবেদিত বাংলা কবিতাকে (যদিও নিজের নিয়মে এরই মধ্যে কিছু ‘কবিতা’-ও এসে পড়েছিল) নির্জন একা-ব্যক্তির কষায় স্বাদের (হরীতকী-স্বাদের বলতে চাইছি) অসীমে অচঞ্চল ভ্রাম্যমাণতায় জীবনানন্দ নিয়ে গিয়েছিলেন, যা পদ্যকৃতিত্ব-অন্বেষীদের বিরূপ করে তুলেছিল, এখনও করে। এর মোটা ধরনের প্রমাণ, পাঁচদশকের অন্তিম থেকে সাতের দশকের, মানে বাংলার ছয়ের দশক থেকে আট দশক পর্যন্ত তরুণদের কবিতাগুলির গ্রন্থনাম প্রায়ই একা, একক, নির্বাসন, নক্ষত্র প্রভৃতি দিয়ে হত। যদিও এই সমূহ টান জীবনানন্দ একা দেননি, আরও আগেই এর যথেষ্ট লক্ষণ ছিল বাঙালিদের আশ্চর্যময়ী আত্মকথায়। জীবনানন্দের নশ্বরতা শেষ হতেই তৎকালীন তরুণ কবিকুল, কমলকুমারের মতো কাব্যলেখক— সর্বোপরি, সময়; সময়ই ওই সময়ে অন্তর্জীবী বাঙালিকে এমন একটা দিকে নিয়ে যায়, রবীন্দ্রগানকে নবধর্মগান করে তোলে। লক্ষ করা যাবেই যে, এই দুই-দশকে বাঙালির বিষয়কর্মে কিছু অমনোযোগ পড়েছিল— মোটা প্রমাণ, ৫৮-র খাদ্যআন্দোলন ছিল নেতৃত্ববিহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল তকমাধারীরাও অনেকসময় কোনও কেরিয়ার না-করে, খ্যাপামি-আড্ডায়-তর্কে দিনযাপন করতেন।

আরও পড়ুন
প্রায় বছর খানেক যে-মনীষীর সঙ্গলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল- যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়

৪৪ থেকে ৭৪ পর্যন্ত জীবনানন্দের যে-পাঠ তা এরকম, আর এই ৭৪ (যখন মাল্যবান বেরোল, ইয়ে, আমরা পড়ার পরও বিয়ে করেছি!) থেকে ৯৪ পর্যন্ত দ্বিতীয় পাঠপর্ব চলেছে। এই পর্যায়ে পাওয়া গেল তাঁর অন্য-এক মুখশ্রী, এখন আর বলা যাবে না যে জীবনের বিনষ্টিকে জীবনানন্দ মাঝে-মাঝে কবিতাশেষের তবু-যুক্ত সদর্থকতার স্বপ্ন দেখিয়ে এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু স্থানসমূহ সময়সমূহও বোধহয় এই সময়টায় পাঠনিবেশ হারিয়ে ফেলেছে, গঞ্জের বর্ধমানতা শহর গ্রাম মফস্বলের আগেকার ভাষা বোধবেদনআবেগরাশি লুপ্ত করে দিয়েছে— কোথাও, এমনি, চুপচাপ পড়ে থাকার কোনও উপায় নেই। রকমারি পাট্টাকবুলিয়ত জৌলুশ হল্লার ফলাফল এই দাঁড়িয়েছে যে, আগে যেখানে ১৪-বছর বয়সেই আমরা ট্রাউজার পরতুম, সেখানে আজ ২৮-বছর বয়েসেও কুঁচকি অবধি তোলা শর্টস-পরিহিত কাউকে দেখলেও কোনও কুঞ্চন পড়ে না ভিতরে। তাহলে? তাহলে ফল এই দাঁড়াল যে, ৪৪-৭৪-এর সেই অভিনিবেশ আর পেলেন না জীবনানন্দ, বাংলা-কবিতায়— বলা যায় বাংলা অন্তর্বর্তী রচনার সদস্যেরা আজ আবার সভাকবিতার দিকে, অধ্যাপক-পৃষ্ঠপোষণার দিকে মুখ ফিরিয়েছেন, কারণ একফর্মা বা অনুরূপ কাগজের শীর্ণ স্বীকৃতি আজ আর প্রাপ্তব্য নয়, প্রতিষ্ঠানেই গতি বাঁধা, আর প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ক কালচার বা অনুষ্ঠান চান, কাজটা না-পেলেও তাঁদের চলে। আর তাঁদেরই চালচিত্র আজ আলাদা সত্যের জোর পায়, কেননা সূক্ষ্মে কোথাও একটা অনধ্যায়ের ঘোষণা হয়েছে, নতুন করে লাগানো গাছগুলিও যেন জেনে গেছে, এখন অনেকদিন অধ্যয়নে আর-কোনও দরকার নেই, তেমন জরুরি নয় ও-জিনিস। ও, হ্যাঁ, তবু তো কিছু পড়তে হয়ই— সে-ও এক ওয়ার্ক কালচার; তো পড়ে নাও, ওই তো স্যাটায়ার-প্যাথস-হিস্টিরিয়ার ট্রিনিটি— ওখানেই ঢুকে পড়ো, ওইটেই খোজাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। পশ্চিমবাংলায় এই ইংরেজি ৮-৯-এর দশকে, আমরা, পূর্বতন বাঙালি দশকগুলির সবরকম সাংস্কৃত্যায়নের চিন্তা থেকে অবসৃত; এত বড় জনঅবসাদকে ঠেলে তুলতে পারছেন না জীবনানন্দও।
দিস ট্যু শ্যাল পাস অ্যাওয়ে,— এই কথায় আস্থা রেখে ভাবা যায়, এই সময়রূপও রূপান্তরিত হয়ে যাবে আর-এক ‘আরে-এদিনটা-ভাবিনি’রূপে; ধরে নেওয়া যাক, শুরু হতে পারে জীবনানন্দের দ্বিতীয় চিন্ময় পাঠ। যদিও কী করে হবে বোঝা যায় না, কারণ যে-বাংলাভাষাটি এখনও জলকে পানি বলে না বা হাতমুখ ধোয়াকে গোসল বলে না, সে আজাদি ইন্ডিয়া কোম্পানীতে ৪৭-বছর থেকেও কিন্তু কাউকে যে ন্যূনতম গ্রাসাচ্ছাদন জোগাতে পারেনি, তা দেখা গেছে। আগেও পারত না, তবু তখন জনওষ্ঠে সুরেশ্চন্দ্র সমাজপতি-উদ্‌ভাবিত ‘দেশাত্মবোধ’ শব্দটির মনোব্যজন ছিল। সেই বাতাসটুকুও গেছে।…
[রক্তমাংস: ১০, এপ্রিল ১৯৯৫; সূত্র: ‘চিত্রগুপ্তধর্মরাজ আর ব্রহ্মশাপের কাহিনী’ শিরোনামে মুদ্রিত, জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কিত ক্রোড়পত্রের প্রথম রচনা।এ ছাড়াও, জীবনানন্দের রচনা নিয়ে ‘তুমি’ শীর্ষকে পার্থপ্রতিমের আরেকটি স্বল্পায়ত নিবন্ধ জানুয়ারি ১৯৯৯-এ ওই পত্রিকার ১৪শ সংখ্যায় প্রকাশ পেয়েছিল।]

 

২০০২ সালে পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল।    ছবি সৌজন্যে: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

আরও পড়ুন
উজ্জ্বল উদ্ধার : শতাব্দীপ্রাচীন নিবন্ধ ‘মহালয়’

ত র জ মা
অ্যাডোনিসের কবিতা
যবনিকা দুলছে
“দেবতা বানাও—  নয় থাকো স্রেফ পড়ে মরে—
খুন করো দেবগণে—  কিংবা, তৈরি হও মরতে— ”
বিগত পাথরগুলি      চুপি চুপি শলা করে
তাদের বিলীয়মান,    হৃত সাম্রাজ্যের মধ্যে।

পাদপ
আমি কোনো তরবারি বহন করি না।
কোনো শীর্ষদেশ আমি তক্ষণ করিনি।
গ্রীষ্মে আর শীতে
আমি সেই পাখি, ক্ষুৎকাতরতার তোড়ে
যে তার খালি বাসার দিকে উড়ে যায়!
আমার সাম্রাজ্য হলো সলিলের পথ।
প্রত্যেক অনুপস্থিতির মধ্যে আমি আছি।
ব্যথায়, কুণ্ঠায়
ঝরায়, খরায়
দূরে বা অদূরে
বস্তুর আলোক আমি অধিকার করি।
এবং যখন আমি যাই,
পৃথিবীর দরজাটা আমার পিছনে আমি
বন্ধ করে যাই।

হাসিনা,আর মুসাফির
‘কে তুমি?’   ‘জেনো, আমি হলাম নির্বাসনে-পাঠানো এক ভাঁড়
    সময়শ্রেণী মাতা আমার, জনক দেবতার’
‘তুমিই তবে আমার দেহ বিশদ করেছিলে
    মীমাংসাকরণে?’
‘শুধুমাত্র গমননির্গমনে।’
‘কি পেলে সন্ধান?’
‘আমার তিরোধান।’
‘এজন্যই কি দ্রুতদৌড়ে গেলে স্নানের সুখে,
                   পোশাক পরার মায়ায়?’
‘যখন তুমি নির্‌বসনা শয়ান ছিলে, আমি
আত্মমুখচ্ছবি তোমার মুখে
পাঠ করেছি। আমি ছিলাম তোমার চোখের সূর্য এবং ছায়া—
সূর্য এবং ছায়া। লুকিয়ে থাকা যেজন হৃদয়গামী
আমাকে আমি ঠিক সেভাবে মনে পড়তে দিয়েছিলাম তোমায়।’
‘তুমি কি জানো এসব আমি লক্ষ্য করেছিলাম?’
‘কিন্তু তাতে কী জেনেছ আমার? এখন তুমি সত্যি আমায় বোঝো?’
‘কখনোই না।’
‘সত্যি কি সন্তুষ্ট হলে, রেখে গেলাম তোমাকে কি খানিকটা ভয়হীনা?— ’
বলতে পারো।’
‘আমাকে কি তারপরও চিনলে না?’
‘না। তুমি চিনতে পারো?’

[অ্যাডোনিস তাঁর তখল্লুস, আসল নাম আলি আহমেদ সয়িদ এসবার (১৯৩০)। সিরিয়ার অল-কাসাবিনে তাঁর জন্ম। দীর্ঘদিনই ফ্রান্সে থাকেন, প্যারিস শহরে। আরবিতে লেখেন স্বনামধন্য নবতিতম কবি। ওই ভাষায় তাঁর অবদান বোঝাতে টি এস এলিয়টের তুলনা টানাও হয়। যাই হোক, ইংরাজি অনুবাদ অবলম্বনে পার্থপ্রতিম-কৃত বাংলা তরজমা প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে ‘ভাষানগর’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায়। মোট পাঁচটির থেকে এখানে তিনটি নেওয়া হয়েছে।পত্রিকার ওই সংখ্যা বহুদেশীয় কবিতার অনুবাদে পরিকীর্ণ ছিল। অনেক বাঙালি কবিই তাতে অনুবাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। প্রস্তুত হয়েছিল ভোপালের ভারতভবনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকবিতা সম্মেলন উপলক্ষ্যে। পরে পত্রিকার ওইসব রচনা নিয়ে বইও হয়েছিল।]

 

ছবি সৌজন্যে: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

আরও পড়ুন
প্রথম দিকে রীতিমতো ধূপধুনো জ্বেলে নাকি আসর বসত আকাশবাণী ভবনে

মাইকেল মধুসূদন দত্তর কবিতা
এক প্রাতর্ভ্রমণকালে রচিত
দিনের সুন্দর শিশুমুখটিকে আমি ভালোবাসি,
শিরোবেষ্টনীতে তার বহুমাল্যদল দীপ্তি পায়;
শুনতে ভালোবাসি গাথা, গির্জাগানে পূর্ণ স্বররাশি
পাইনের ডালে মধুকোকিলে যে সংগীত শোনায়:
আমি দেখতে ভালোবাসি তোমাকে, হে স্রোতের আধার
বিনম্র কুমারীরূপে লজ্জারুণা, আনন্দপ্রাণিতা,
যখন আলোকবন্যা অদূর মিহিরে, রশ্মি তার
অমল, কম্পিত, স্বচ্ছ তোমার ও বুকে সম্মিলিতা;
আমি দেখতে ভালোবাসি মৌমাছিকে পুষ্পে পুষ্পান্তরে,
মাধুর্য সে পান করছে, ফুল দিচ্ছে বশ্যতা সুস্মিত;
আমি শুনতে ভালোবাসি মধুবায়ু গাইছে কুঞ্জঘরে
সুস্বর-সুতানে, বা সে গান গেয়ে প্রান্তরে বাহিত;
ভালোবাসি এই সব, আর, ওহ্‌! এসবেই পাই
মনের জ্বরোপশম-দাত্রী বিলেপনের দাওয়াই!

[শেক্সপিয়রীয় সনেটের আদলে লেখা মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র Composed During A Morning Walk-এর পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল-কৃত বাংলা অনুবাদ সব দিক থেকেই মূলানুগ। প্রকাশ: ‘নবপত্রিকা’ (একদিন দৈনিকের রবিবাসরীয়), ১৫ এপ্রিল ২০১২/ ২ বৈশাখ ১৪১৯। তিনি ছাড়াও উৎপলকুমার বসু, অমিতাভ গুপ্ত এবং উত্তম দাসের অনুবাদও ছিল সেখানে। তবে পার্থপ্রতিম এবং উত্তম দাস ছাড়া বাকি দু-জন তাঁদের অনুবাদে মূলের রীতিমাফিক ছিলেন না।
বলে রাখা ভালো, এর বাইরেও পার্থপ্রতিমের অনুবাদকর্ম রয়ে গেছে। উনিশ-শো পঁচাশিতে তিনি ভগবদ্‌গীতার পঞ্চদশ অধ্যায় ‘পুরুষোত্তমযোগ’এর তরজমা করেন এবং সেইসঙ্গে অনুবাদকের কৈফিয়তও দিয়েছিলেন। অনুবাদের গুণাগুণ যা-ই হোক, তথ্য স্বরূপ এখানে তার উল্লেখ করা গেল।]

কবি-নিবন্ধকার পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের অগ্রন্থিতই বেশি তাঁর সংকলিত রচনার চেয়ে। দীর্ঘদিন দৃষ্টির আড়ালে থাকার দরুন তাঁর বহু রচনাই এখন অনুরাগী পাঠকেরও স্মৃতিচ্যুত হচ্ছে। অবস্থা এমনই। কবিও তাঁর জীবিতাবস্থায় নিজের সংকলনের ব্যাপারে একপ্রকার উদাসীনই ছিলেন। অথচ অন্যের ক্ষেত্রে সবসময়ই উৎসাহদাতা এবং গ্রন্থনাতেও সহায়ক হয়েছেন। তাঁর যা-কিছু এখনও লভ্য, সেসবের সংকলন খুবই জরুরি। বিশেষত গদ্যরচনা, কবিতা এবং অনুবাদের ক্ষেত্রেও যা অগ্রন্থিত, সেসবের হদিশও পাওয়া দরকার। সে-কাজে অনেকের স্মৃতির সহায়তা প্রয়োজন। তাঁর সমসাময়িক এবং অপেক্ষাকৃত অনুজ আগ্রহীদের মিলিত পরিশ্রমই যে সে-কাজকে সফল করে তুলতে পারে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আমাদের আশা যদি দুরাশা না হয় শেষ অবধি, সহৃদয় কোনো উদ্যোগ সেভাবে গড়ে উঠলে নিশ্চিত খুশি হব আমরা।

পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল
পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (১৯৪৯-২০২০): কবি ও নিবন্ধকার। উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ (প. ব. সরকার)-এ কর্মরত ছিলেন। একজীবনে বিপুল আড্ডাধারী মানুষটি অবসর নেওয়ার পর ক্রমশ গৃহবদ্ধ হয়ে পড়েন। কিছুটা শারীরিক গোলযোগেও চলাচল কমে আসার দরুন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ মূলত ফোনালাপেই ঘটত। সিঁথিতে স্বগৃহেই থাকতেন বেশিরভাগ সময় নিজের পড়াশুনো এবং লেখালেখি নিয়ে। সংকলিতের চেয়ে তাঁর অগ্রন্থিত রচনার পরিমাণই বেশি। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি: দেবী (১৯৭০), রাত্রি চতুর্দশী (১৯৮৩), টেবিল, দূরের সন্ধ্যা (১৯৮৪), পাঠকের সঙ্গে, ব্যক্তিগত (২০০১), ধর্মপুত্র, এখানে আসুন (২০০৭), বহিরাগত (২০০৮), বর্ণজীবের সনেট এবং আগন্তুক (২০১৩) প্রভৃতি। 

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
20FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!