আমরা কথায় কথায় স্বপ্নকে ধাওয়া করার পরামর্শ দিয়ে থাকি অপরকে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ক’জন নিজের স্বপ্নকে ধাওয়া করতে পারি বলুন তো! হয়তো অনেকেই নিজের শখ পূরণ করি সময় বের করে। অথচ পিছুটানহীনভাবে শহুরে স্বাচ্ছন্দ্যকে পিছনে ফেলে এসে ক’জন নিজের স্বপ্নকে পেশা বানিয়ে ফেলতে পারি! বাস্তব ক্ষেত্রে তেমনটাই করে দেখাচ্ছেন খাস কলকাতার এক যুবক এবং শিলংয়ের এক যুবতী । এরা হলেন অমিত রায় আর মোমো ভট্টাচার্য্য।
প্রাণিবিদ্যার ছাত্র অমিতের শুরুটা কিন্তু আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতোই হয়েছিল। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী মোমো একদম অল্প বয়স থেকেই নারী বিকাশ, শিশু কল্যাণ, সমাজ কল্যাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে হিমালয়ের গ্রামে গ্রামে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি মেটাল ব্যান্ডের ভোকালিস্ট মোমোর সঙ্গে মেটাল-অন্তঃপ্রাণ অমিতের প্রাথমিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে এবং সেই সম্পর্ক গভীর হতে বেশি সময় লাগেনি। অন্যদিকে শিক্ষকতা, এন.জি.ও.-র ইন্টার্নশিপ, আইটি সেক্টরের চাকরি … অর্থ জোগাড় করতে এ সব পথেই চলতে হয়েছে অমিতকে। ক্রমে দুজনে বৈবাহিক সম্পর্কেও বাঁধা পড়েন।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকারের জন্য প্রচারমূলক চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতেন ওয়াল্ট ডিজনি!
চাকরি করে অর্থ তো উপার্জন হলেও, শান্তি ছিল না মনে। কী করে থাকবে! বিশ্বজুড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তন এবং ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকা জীববৈচিত্র্য দেখে আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব ছিল না অমিতের পক্ষে। তাই চাকরি ছেড়ে একটা বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন অমিত। মোমোর অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করে ফেললেন ‘গ্রীন অ্যামো’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পাশে পেলেন মুগ্ধা, নভজ্যোৎ, পদ্মিনী, বিকাশ আর হিরণ্যকের মতো তরুণ-তরুণীদের। এদের কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার, কেউ শৈল্পিক পরামর্শ, কেউ আবার আইনি পরামর্শ কিংবা হিসাবরক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন
কল্প কাহিনীতে নয় বরং বাস্তবেই রয়েছেন একজন টারজান, জেনে নিন আধুনিক এই টারজানের কাহিনী
‘গ্রীন অ্যামোর’ প্রধান উদ্দেশ্য হল প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল অর্থাৎ পুনর্ব্যবহার করার বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা এবং স্যানিটারি বর্জ্যঘটিত দূষণরোধে মানুষের সচেতনতাকে বাড়িয়ে তোলা। সেই উদ্দেশ্যেই ‘গ্রীন অ্যামো’ জন্মলগ্ন থেকেই দূর দূরান্ত পৌঁছে সেই সমস্ত অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কখনও পৌঁছে গেছে হিমাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত কালগা গ্রামে, কখনও দার্জিলিং জেলার বিজনবাড়িতে, কখনও আবার নেপাল আবার কখনও চেন্নাইতে। সেখানে তারা বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিন ব্যাগ সংগ্রহের পাশাপাশি সেগুলি থেকে বটল ব্রিক (প্লাস্টিকের বোতলের ইঁট) তৈরি করেছে। মেঘালয় ও দার্জিলিংয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে অস্থায়ী সংগ্রহশালা, শৌচালয়, স্কুল-প্রাঙ্গনে বিভিন্ন অস্থায়ী ঘর ইত্যাদির নির্মাণকার্যে সেই প্লাস্টিক বোতলের ইঁট ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের বিনামুল্যে সেই ইঁট দিয়ে কফি টেবিল, ল্যাম্প স্ট্যান্ড ইত্যাদি তৈরির পদ্ধতি শিখিয়ে এসেছে ‘গ্রীন অ্যামো’। শুধু তাই নয়, তাদের তৈরি সেই আসবাব বিক্রির বাজারও খুঁজে দিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন
এছাড়া ‘গ্রীন অ্যামো’ কিশোরী ও মহিলাদের মধ্যে পরিবেশ দূষণ সৃষ্টিকারী স্যানিটারি ন্যাপকিনের পরিবর্তে সিলিকন মেন্স্ট্রুয়েশন কাপ ব্যবহারের উপযোগীতা বিষয়ক প্রচার করে থাকে। পাশাপাশি গ্রীন ট্রেক, গ্রীন ক্যাম্পের মতো উপভোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করে পর্যটনস্থল থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করতে সাধারণ পর্যটককে উৎসাহ দিয়ে থাকে এই সংস্থা।প্রকৃতি যখন ধীরে ধীরে মনুষ্যসৃষ্ট বিষপানে জর্জরিত হয়ে উঠছে, তখন অমিত ও মোমোর মতো কিছু মানুষ প্রকৃতির হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের আশাটুকু জুগিয়ে চলেছে। ভিন্নসময় টিম এই সকল যোদ্ধাদের কুর্ণিশ জানায়।