২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

ফিরে দেখা: চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলায় কীর্তন আর বাউলে শিকড়ের টান

খ্রিস্টোৎসব উদ্‌যাপনে মহানগরীর সড়কে চোখ-ঝলসানো রোশনাই, রাংতার সাজসজ্জা, হইহুল্লোড় আর সান্তা ক্লজ বা কেক-বিলানোর শহুরেপনার বিপরীতে মফস্‌সল বাংলার কিছুটা গ্রামীণ পরিবেশে ক্রিশ্চান অধ্যুষিত পাড়ায় পাড়ায় রঙিন শিকলির বাহার, ঘরে ঘরে সামর্থ্যমতো সুখাদ্যের নানা আয়োজন, অতিথি আত্মীয় কুটুমের আসা, প্রবাসীর ঘরে ফেরা, পিঠেপুলির স্বাদু গন্ধ— সব কিছু মিলে সেই চিরন্তন বাঙালিয়ানারই আরেক পর্ব দেখে অভিভূত হয়েছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত লেখক সুধীর চক্রবর্তী (১৯ সেপ্টম্বর ১৯৩৪- ১৫ ডিসেম্বর ২০২০)মহাশয়। তাঁর সেই সরস বিবরণেই সমৃদ্ধ এবারের ফিরে দেখা বিভাগটি। লোকসংস্কৃতির আঙিনায় তাঁর দীর্ঘদিনের গতায়াতে বহুফসলি কলমের আখরগুলি সুপরিচিত অনেকেরই। তারই অংশ কিছু ভিন্নসময়-এর পাঠকদের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে তাঁর পশ্চিমবঙ্গের মেলা ও মহোৎসব (১৯৯৬) গ্রন্থটি থেকে। লেখক-স্মরণে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ এই রচনা প্রকাশের দরুন উক্ত গ্রন্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের কাছেই আমরা কৃতজ্ঞ রইলাম।

 

চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলার কথা বহুবার শুনেছি, কিন্তু মনে হয়েছে একটা বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের মেলায় আমার কীই-বা পাবার থাকতে পারে? আসলে মেলা বা মহোৎসব সম্পর্কে আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু স্বচ্ছতার অভাব আছে সেটা বুঝলাম খ্রিস্টীয় মেলা প্রসঙ্গে। ব্যাপারটা সহজ করে বললে এই দাঁড়ায় যে সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের একটা লোকায়ত স্তর আছে, অন্তত আমাদের বাংলায়। তার কারণ চাপড়ার যে-খ্রিস্টমণ্ডলী বড়োদিনের মেলা সংগঠন করছেন তাঁরা প্রোটেস্ট্যান্ট এবং তাঁরা সকলেই গ্রামীণ হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত। ধর্মান্তরিত হবার কারণে তাঁদের কারুর কারুর প্রথম নামটা বদলে গেছে বা সামনে একটা খ্রিস্টীয় নাম বসেছে, কিন্তু পদবি আছে অক্ষুণ্ণ। ফলে গ্রামীণ সমাজবিন্যাসের কোন থাকে তাঁদের অবস্থান ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার পরবর্তী বোধে এটা ধরা পড়ে যে, গ্রামীণ লোকায়ত বিশ্বের উদার পরিমণ্ডলে কৃষ্ণ, খ্রিস্ট বা আল্লাভজাদের মধ্যে ধর্মাচরণের পার্থক্য থাকলেও রুচি, খাদ্যাভ্যাস, উৎসবের ধরন আর আনন্দ বিনোদনে খুব একটা তফাত নেই।

চাপড়ার বড়োদিনের মেলা শুরু হয় ২৬ ডিসেম্বর, শেষ হয় ১ জানুয়ারি। এ ক-দিন চাপড়ার ক্রিশ্চান অধ্যুষিত পাড়ায় পাড়ায় রঙিন শিকলির বাহার, ঘরে ঘরে সামর্থ্যমতো সুখাদ্যের নানা আয়োজন, অতিথি আত্মীয় কুটুমের আসা, প্রবাসীর ঘরে ফেরা, পিঠেপুলির স্বাদু গন্ধ— সব কিছু মিলে সেই চিরন্তন বাঙালিয়ানারই আরেক পর্ব। যাঁর বাড়িতে বসে চমৎকার নলেন গুড়ের পায়েস খাচ্ছি তাঁর নাম হয়তো নাথানিয়েল বিশ্বাস, যিনি পায়েস রেঁধে পরিবেশন করলেন তাঁর নাম হেলেনা, কিন্তু বসেছি সেই মেটেঘরের দাওয়ায়। উঠোন আঙিনায় ক-টা পেঁপে গাছ, আতা আর পেয়ারা গাছ। কলার ঝাড় একপাশে, সামনে সন্ধ্যামণি আর গাঁদার বর্ণময় শোভা। এসব কিছুর সঙ্গে সংগতি রেখে দাওয়া থেকে কান ঝটপট করে নেমে এল একটা খেঁকি কুকুর। তার নাম জিমি বা রক্সি নয়, নিতান্তই ভুলো বা কেলো। এসব বাড়িতে কলকাত্তাই ঢঙে চোখ-ঝলসানো রোশনাই বা রাংতার সাজসজ্জা নেই, নেই সান্তা ক্লজ বা কেক বিলানোর শহুরেপনা। বাড়ির গেটে বড়োজোর বাঁশ বেঁধে তাতে দেবদারু পাতার আচ্ছাদন দেওয়ায় গ্রামীণ শোভনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তবে হ্যাঁ, এখানকার সব সম্প্রদায়ের যেকোনো উৎসবের মতো সর্বত্র বাজছে মাইক। মাইকে প্রচারিত গানগুলিও ধর্মসংগীত বা খ্রিস্টভজনার গান নয়, নিতান্ত হালফিল সিনেমার গান। ‘আগে ছিল গানবাজনা, এখন হয়েছে বাজনাগান’ বলেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে। তো সেই বাজনাগান বাজছে তারস্বরে। পাড়া পরিক্রমা করছি আমার প্রাক্তন ছাত্রী অর্পিতা আর তার বাবা সৎশরণ বিশ্বাসের সঙ্গে। অর্পিতা বললে, ‘স্যার চাপড়ার বড়োদিন মানেই বাড়ি বাড়ি মাইক। এ ক-দিন কান পাতা যাবে না।’

আরও পড়ুন
পাঠকের ব্যক্তিগত: শঙ্খ এবং অলোকরঞ্জনের কবিতা প্রসঙ্গে পার্থপ্রতিম

হয়তো বাড়ি বাড়ি নয়, তবে দু-পাঁচখানা বাড়ি অন্তর মাইক বাজছে। উৎসবের আনন্দ যুব সম্প্রদায়ের। ধর্মটর্ম নয়, একটা উপলক্ষ্যকে ঘিরে হুজুগ। সৎশরণবাবু পেশায় শিক্ষক, শান্তপ্রকৃতির পঞ্চাশ পেরোনো মানুষ। এঁর দাদামশাই মতিলাল মল্লিক ছিলেন এখানকার খ্রিস্টমণ্ডলীর পাদ্রি। তাই ধর্ম সম্পর্কে একটা সাত্ত্বিক ধারণা সৎবাবুর জীবনের অন্তর্গত। তিনি বললেন, ‘আপনাদের যা আমাদেরও তা, একই সমস্যা। ধর্মের ভেতরকার শুদ্ধভাব নেই, পার্থনা নেই, আছে হুজুগ আর লঘুভাব। তা ছাড়া ভেবে দেখুন, আমাদের ধর্মে উৎসবের সংখ্যা খুব কম। মাত্র দুটো। আর আপনাদের বারোমাসে তেরো পার্বণ।’

–আপনাদের দুটো উৎসব কী কী?
–একটা বড়োদিন, আর একটা ইস্টার বা গুড ফ্রাইডে। ব্যাস। এই দুটো উপলক্ষ্যে ছেলেমেয়েরা একটু আনন্দ করে। নাচে, গায় এই আর কী!
–৩১ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারির সময়টাকে নাকি অনেকে ছোটো বড়োদিন বলে?
–হ্যাঁ। অনেকে বলে।
–জানেন তো আমাদের দুর্গাপুজোকে অনেকে বলে বড়োপুজো?
–তাই নাকি? হ্যাঁ, আপনাদের যেমন বড়োপুজো আমাদের তেমনই বড়োদিন। আনন্দের উৎসব। তবে মেলার ব্যাপারটা এখানে অভিনব। তার হিস্ট্রিটা জানতে যেতে হবে আমাদের হেডমাস্টারের কাছে। চলুন যাবেন?
–যাব। কিন্তু সবচেয়ে আগে যাব আপনাদের বাউলগায়ক শামিয়েল মণ্ডলের কাছে। তার গলায় বাউল গান অনেক শুনেছি মোচ্ছবে আর ফকিরদের আখড়ায়।
–শামিয়েল কীর্তনও খুব ভালো গায়।
–কীর্তন? কী বিষয়ে কীর্তন?
–কেন? খ্রিস্ট বিষয়ে কীর্তন? ও, এ ব্যাপারটা জানেন না বুঝি? শুনুন, বহুবছর আগে এখানে মানে চাপড়ার খ্রিস্টমণ্ডলীতে প্রথম কীর্তনের দল গড়েন আমার দাদামশাই মতিলাল মল্লিক। শুনেছি তিনি নবদ্বীপে গিয়ে কীর্তন শিখে এসেছিলেন।

সুধীর চক্রবর্তী, ১৯ সেপ্টম্বর ১৯৩৪- ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

এবারে আমি চমকাই। একজন খ্রিস্টান পাদ্রি নবদ্বীপে গিয়ে প্রথাবদ্ধ কীর্তন শিখে এসে গান বেঁধে দল বানিয়ে কীর্তন গেয়ে বেড়াতেন? এবারে যেন অনেকটা ধরতাই পেয়ে যাই। ধরতে পারি এখানকার মেলাপত্তনির একটা সরল সূত্র। সৎশরণবাবুর দাদামশাই মানে একশো বছর আগের ব্যাপার। তার মানে তো এখানকার মেলা একশো বছরের পুরোনো? না, সঙ্গের সুভেনিরটায় দেখছি লেখা আছে: ‘খ্রীষ্টিয় মেলা ও প্রদর্শনী। চাপড়া। ৮১তম মেলা ১৯৯৫।’ তবে? কথায় কথায় জানা গেল এ অঞ্চলে খ্রিস্টীয় মেলার সূচনা হয়েছিল চাপড়া থেকে বারো মাইল দূরে বল্লভপুর মণ্ডলীকে ঘিরে। বল্লভপুর এখন বাংলাদেশে। চাপড়ার মেলার পত্তন হয়েছে বল্লভপুরের পরে। এসব পুরোনো কথা জানবার উপায় কী? মতিলাল পাদ্রির কীর্তনের দলের কেউ কি বেঁচে আছেন? হ্যাঁ, আছেন।

আরও পড়ুন
ভাইফোঁটা: যমের বিরুদ্ধে বাঙালি বোনেদের চ্যালেঞ্জ

সৎবাবু আমাদের নিয়ে গেলেন সেই কীর্তন-প্রজন্মের শেষ জীবিত সদস্য সিদ্ধধন বিশ্বাসের বাড়ি। ইটের পাকাবাড়ির বার-বারান্দার চৌকিতে বসে দিনরাত কাটে সিদ্ধধনের। বয়স ৮৩ পেরিয়েছে। শীর্ণ বৃদ্ধ। তবে স্মৃতি খুব টাটকা। আমার প্রশ্নের উত্তরে বলে গেলেন: ‘মতিলাল পাদ্রির দলে আমিও ছিলাম একজন গাহক [য.]। আর ছিলেন সমর মল্লিক, দানিয়েল মণ্ডল, তেজস মণ্ডল আর সিমন পাদ্রি। শিক্ষা আমাদের ওই মতিলালবাবুর কাছে। গান বাঁধতেন তিনি। বড়োদিনের সময় আর অন্য পার্বণে আমরা কীর্তন গাইতাম। পাড়ার ভেতরে গানের পরিক্রমা হত।’

বড়োদিন উপলক্ষ্যে সেজে উঠেছে চাপড়ার ক্রাইস্ট চার্চ  

আমি বললাম, ‘কীর্তন বলতে একেবারে শাস্ত্রীয় সংগীত রীতির?’
–হ্যাঁ। ধরুন রাগরাগিণীর কীর্তন। মধ্যম দশকুশি, ১৪ মাত্রার তিওট, ছোটো একতালা, ডাঁসপেরে, রং ডাঁসপেরে এসব কঠিন তাল আমাদের জানা ছিল। চাপড়ায় ছিল তখন দুটো দল। আমরা গাইতাম কীর্তন আর যোসেফের পালা। এগজামিন হত।
–এগজামিন মানে কমপিটিশন?
–ওই আর কী। আমরা বলতাম এগজামিনের গান। সেই এগজামিন হত বল্লভপুরে। আমরা খোল-করতাল নিয়ে যেতাম। তখন হারমোনিয়াম ছিল না। বাস তখন চালু হয়নি। হেঁটে, ৬ ক্রোশ রাস্তা মেরে দিতাম। বল্লভপুরে অনেক কীর্তনের দল আসত। ডোমপুকুর, চারাতলা, রতনপুর, কাপাসডাঙা, ভবেরপাড়া, যুগিন্দে, নিত্যানন্দপুর থেকে দল আসত। খুব বড়ো এগজামিন।
–বিচার করতেন কে? মনে আছে?
–হ্যাঁ, সবই মনে আছে। ছিলেন কেদারগঞ্জের ক্ষিতীশবাবু। তিনি হিন্দু। তারপরে বিচারক ছিলেন সূর্য ফকির আর বিহারী পাদ্রি।
–সূর্য ফকির মানে কি একজন ফকির নাকি? তিনি করতেন কীর্তনের বিচার?
–না না, ফকির ছিলেন না। তবে লোকে ওই নামে ডাকত। বিহারী পাদ্রি মানেও বিহারের মানুষ নন, বিহারীলাল বারুই, বুঝলেন?

আরও পড়ুন
এখানকার কালীপূজা হিন্দুদের যতটা মুসলমানদেরও ততটা

এভাবেই মিলে গিয়েছে কীর্তনের সঙ্গে খ্রিস্টের বন্দনা

সত্যিই ভারি বিচিত্র আখ্যান শুনছি। কত বছর আগে ধুলোডোবা এসব গাঁয়ে-গঞ্জে ছিল শুদ্ধ কীর্তনের দল। মানুষগুলি বাড়িতে কাচা ধুতি-শার্ট পরে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে জমা হতেন বল্লভপুরে। এগজামিন হত। পুরস্কার জুটত নগদ টাকা। এখনও নদিয়ার প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টমণ্ডলীতে অনেক কীর্তনের দল আছে। তাঁরা কেমন গান করেন? সিদ্ধধন বলেন, ‘দলের সংখ্যা এখন অনেক বেশি, কিন্তু আমাদের মতো ওস্তাদি তাদের নেই। কঠিন তাল এরা জানে না। সমাদরও কম।’
–কেন?
–এখন তো ছেলেছোকরাদের ধর্মের টান কম। সাধনা কম। তা ছাড়া আমাদের সময়ের মতো ওইরকম কঠিন এগজামিনও নেই। এখনকার কীর্তনের দল কি ৬ ক্রোশ হাঁটবে?
আমি বললাম, সেকালের কোনো কীর্তন মনে আছে আপনার? গাইবেন?
–মনে আছে অনেক গান, কিন্তু গাইব কী করে? তিরাশি বয়স হল। গলার তেজ আর নেই।
–অন্তত একটা গানের বাণী বলুন, লিখে নিই।
সিদ্ধধনের বার্ধক্যবিহত মুখে জ্বলে উঠল চমৎকার আলো। বেশ প্রত্যয়ভরা গলায় বললেন, ‘গান একখানা লিখবেন? খুব ভালো। তবে বড়োদিনেরই একটা কীর্তন গান লিখে নিন। লিখুন—
         তাই তো বলি দ্যাখ গো দ্যাখ
          গোশাল মাঝে দ্যাখ—
কীবা স্বরূপ নয়নে আজ সব দ্যাখ॥
গোশাল মানে বুঝলেন তো?’
–হ্যাঁ। গোশালা মানে যেখানে যিশুর জন্ম।
–ঠিক। এবারে লিখুন—
              কীবা ভঙ্গি সারঙ্গ পর
              পরনে কৌপীনধর তব মনোহর।
              মধুর হাসিতে সে অধর আর ধরে না
(চেয়ে চেয়ে মধুর হাসিতে সে অধর আর ধরে না)
               গোশাল আলো করে কী সুন্দর রূপ ধরে
                     বন্দিতে বলিহারি আহা কীবা মাধুরী।
               আমরা রাখালদল দেখতে পেলাম
                      সে রূপ দেখে ফিরে আসতে মন সরে না
(আহা চেয়ে চেয়ে সে রূপ দেখে ফিরে আসতে মন সরে না)।

ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে চার্চে চলছে খ্রিস্টকীর্তন

আরও পড়ুন
ফিরে দেখা: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়ানে জোড়াসাঁকোর দুর্গাপুজোর স্মৃতি

আমি বললাম, আখরও আছে দেখছি।
–হ্যাঁ পাকা কীর্তন তো। তালটা হাতে বলছি…
সৎশরণ বললেন, এটা কী তাল?
–১৪ মাত্রার তিওট।
আমার মনে হল সত্যিকারের একটা বড়োদিন আজ। নতুন রকম ঐতিহ্য আর মানুষ খুঁজে পেলাম যেন। যিশুকে কৌপীনধর বলে বর্ণনা করার সজীবতা এমন লোকায়ত সমাজেই সম্ভব। কিন্তু কীর্তন গানের ঐতিহ্য আর শিল্পীসমাজ এখানে গড়ে উঠল কী করে?
সন্ধানী মন ছটফট করে, এমনতর খ্রিস্টীয় মেলার প্রবর্তনই-বা কার? সেসব সুলুকসন্ধান জানতে চলি চাপড়া কিং এডওয়ার্ড স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। কাগজে-কলমে দেখতে গেলে চাপড়ার প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ আর কিং এডওয়ার্ড স্কুল সমসাময়িক। ১৮৪১ সালে এ দুয়ের প্রতিষ্ঠা। কেমন করে গড়ে উঠেছিল এখানকার খ্রিস্টমণ্ডলী তা জানতে চার্চ মিশনারি সোসাইটির ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়। ষাটের দশকে যখন ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মতত্ত্ব পড়তে ফাদারদের কাছে ঘুরতাম তখন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইউজেনা স্টকের লেখা সি.এম.এস-এর হিস্ট্রি পড়ে নিয়েছিলাম। সঙ্গের খাতা খুলে চোখ বুলিয়ে নিলাম। স্টক লিখছেন:
In 1831, one of the German Missionary at Burdwan, W. J. Deerr, visited Nadiya, a sacred Hindu town, and the birth place of Chaitanya, the Vaishnava reformer of the sixteen century. Thence he crossed the river Hooghly and made his way to another important town, Krishnagar, where he started a Vernacular School.

চাপড়া কিং এডওয়ার্ড স্কুল

আরও পড়ুন
ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মস্থান বীরসিংহ বাঙালির আবেগে জায়গা করে নিলেও, কর্মাটাঁড় আজও অবহেলিত

এখানে Nadiya মানে নবদ্বীপ এবং মিশনারি ডিয়ারের স্থাপিত স্কুলটি হল কৃষ্ণনগরের সেন্ট জনসন সি.এম.এস. স্কুল। দেড়শো পেরিয়ে সেই বিদ্যায়তন আজও শোভমান। এই কৃষ্ণনগর থেকে ডিয়ার গেলেন নিকটবর্তী গ্রামে। বিবরণে রয়েছে:
In a village Deerr came across some members of a curious community called Karta Bhaja, ‘Worshippers of the creator’, one of the numerous sects, half Hindu and half Muslim, which have from time to time risen up to protest against the tyranny of the Brahmans. In 1833, thirty persons of the sect was baptized in the face of much persecution. The movement went on without much being said or thought about it, until 1838, when suddenly the leading men in ten villages, including with their families some five hundred souls, simultaneously embraced the Gospel of Christ and after some months of instructions, were baptized. The Society at home some heard of it early in 1838.

বড়োদিনে চার্চের ভেতরের সজ্জা

বিবরণ থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের শাসন ও দলনে নিম্নবর্গের বেশ কিছু মানুষ আগেই হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ‘কর্তাভজা’ হয়ে গিয়েছিএলেন। পাদ্রি ডিয়ার সেখানেই প্রয়াস নিয়েছিলেন ধর্মান্তরকরণের। ১৮৩৮-৩৯ নাগাদ সে কাজ সম্পন্ন হয় এবং ১৮৪০ সালে চাপড়ার খ্রিস্টমণ্ডলী পত্তন আর চার্চের সূচনা কি এই ইঙ্গিত দেয় যে এখানকার খ্রিস্টীয় সমাজ বহিরাগত?
হেডমাস্টার প্রভাতরঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলবার সময় পাদ্রি ডিয়ারের এসব কার্যকলাপের খবর না জানিয়ে সরাসরি জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা বলতে পারেন এখানে কীর্তনের দল গড়ে উঠল কেন?’
প্রভাতবাবু বললেন, এখান থেকে পশ্চিম দিকে অনেকটা গেলে দ্বীপচন্দ্রপুর বলে একটা গ্রাম পড়ত।

আরও পড়ুন
ঈশ্বরচন্দ্রের সাধের ‘নন্দনকানন’, তাঁর নিজের হাতে গড়া এক কর্মকাণ্ড

–পড়ত বলছেন কেন? এখন পড়ে না?
–না, এখন গ্রামটা আর নেই। নদীগর্ভে গেছে। সেই দ্বীপচন্দ্রপুরের বাসিন্দারা ছিলেন কর্তাভজা। তাঁরাই প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম নিয়ে চাপড়ায় এসে বসতি করেন, মণ্ডলী গড়ে ওঠে। কর্তাভজারা আগে কীর্তন করতেন। তাঁরাই এখানকার খ্রিস্টকীর্তনের দল চালু করেন।
এতটা সমাপতন আশা করিনি। তথ্য, ইতিহাস, অনুমান এমন করে মিলে যায়? কী আশ্চর্য বড়োদিন! কী উদ্বেলিত আমার পক্ষে, কতটাই বর্ণময় উদ্ভাসন তার।
কিন্তু চাপড়াতে এমন খ্রিস্টীয় মেলার শুরু কবে থেকে? সুভেনিরে লেখা আছে ১৯৯৫ সালে ৮১তম মেলা। অথচ হেডমাস্টারমশাই ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসের ‘নবায়ন’ পত্রিকায় লিখেছেন:
চাপড়াতে প্রথম মেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৪-এর ১লা জানুয়ারি পর্যন্ত যখন সমগ্র নদীয়া উত্তাল নদীয়া খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে।…মি. ডিয়ার (সি. এম.এস. মিশনারী) যিনি নদীয়া মণ্ডলীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন, শতবর্ষে তা শতগুণ সহস্রগুণ বর্ধিত হয়ে নদীয়ার একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে।

চলছে চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলা

এই হিসাবে চাপড়ার খ্রিস্টমেলা ৬২ বছরে পা দিল এবার, কিন্তু সুভেনিরে কেন ৮১তম মেলা বলা হচ্ছে? তার সমর্থনে ওই লেখার পরবর্তী অংশ দেখা যাক। বলা হয়েছে:
এ হেন এক খ্রীষ্টীয় মেলার প্রথম সূত্রপাত বল্লভপুর। পটভূমি তৈরি হয়েছিল ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে মি. চার্টনের আগমনে। তিনি নদীয়া মণ্ডলীর দায়িত্ব পান ও নদীয়ার জীবনে নবজাগরণের জন্য তিনি, তাঁর স্ত্রী ও ভগ্নী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।…মি. চার্টন আধ্যাত্মিক চেতনাকে স্থায়িত্ব দেবার জন্য বল্লভপুরে বিশ্বাসী বর্গের বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করলেন।…ইতিমধ্যে নদীয়ার কর্তাভজা সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ খ্রীষ্টবিশ্বাসী হয়েছেন। যাদের কণ্ঠে ছিল খ্রীষ্টপ্রমের কীর্তন। বল্লভপুরের সম্মেলনে ঐসব কীর্তনীয়াদের আকর্ষণে বহু দূর-দূরান্তর থেকে পায়ে হেঁটে, গরুগাড়ী চেপে ভক্তেরা জড়ো হোত। ক্রমান্বয়ে এই সম্মেলন রূপ পেল বাৎসরিক খ্রীষ্টীয় মেলায়। মেলার আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা হোল খেলাধূলার ও গ্রাম্যশিল্পের প্রদর্শনী। গ্রামীণ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য মেলার সঙ্গে সংযোজিত হোল কৃষিজাত দ্রব্যের প্রদর্শনী, গৃহপালিত জীবজন্তুর ও সূচীশিল্পের প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনী।

আরও পড়ুন
প্রায় বছর খানেক যে-মনীষীর সঙ্গলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল- যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়

স্বাধীনতার পর দ্বিখণ্ডিত নদিয়ার খ্রিস্টীয় মেলা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হতে থাকল বল্লভপুর ও চাপড়ায়। মেলার একটা অর্থ মেলামেশা, কিন্তু দেশভাগ হয়ে সেই মেলামেশায় পড়ে গেছে বিভাজন রেখা। চাপড়া আর বল্লভপুর মাঝখানে ১০-১২কিলোমিটারের ব্যবধান, তবু মনের টান যাবে কোথায়? চাপড়ার মানুষ বড়োদিনে যান সীমানা পেরিয়ে, চাপড়ার বড়োদিনের মেলায় বল্লভপুর থেকে অনেকে চলে আসেন। আত্মীয়পরিজন দু-দিকেই ছড়ানো।

মেলার মঞ্চে চলছে খ্রিস্টকীর্তন

প্রাতিষ্ঠানিক উপাসনাকেন্দ্রিক এই ধর্ম আর মেলা আজ সার্বজনীন রূপ পেয়েছে। মেলা কমিটি লিখিতভাবে সবাইকে আনন্দযজ্ঞে আমন্ত্রণে জানিয়েছেন: ‘জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভাইবোনদের মেলাতে যোগদানের জন্য জানাই আন্তরিক নিমন্ত্রণ। আপনাদের উপস্থিতি আমাদের পাথেয়।’ এ আবেদন ব্যর্থ হবার নয়। তাই চাপড়া চার্চের সন্নিহিত কিং এডওয়ার্ড স্কুলের বিশাল প্রাঙ্গণে ও মাঠে বছর বছর বসে অনবদ্য খ্রিস্টীয় মেলা। ২৬ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ক-টা দিন হেঁটে, সাইকেলে চড়ে, স্কুটারে ও বাসে হাজার হাজার মানুষ আসেন। তাঁরা হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান। আসেন ধর্মের শীর্ণ পরিচয় ভেঙে মানবতার ঔদার্যে।

আরও পড়ুন
২০০ বছরে বিদ্যাসাগর: ফিরে দেখায় মাইকেল মধুসূদন

সৎশরণবাবু খেই ধরিয়ে বলেন, ‘মূল ভাবনাটা বিদেশি পাদ্রিদের। ধর্মোৎসবকে জনপ্রিয় করার এই একটা উপায়। তবে বদলে গেছে আজকের পরিবেশ আর মূল উদ্দেশ্য। ধ্যান, প্রার্থনা এসব আমরা ছোটোবেলায় দেখেছি। এখন মেলার নামে স্রেফ আমোদ, ফুর্তি, খেলাধুলো, সাজগোজ।’

সরগরম মেলার মাঠ

তা হোক, তবু অভিনব এই মেলা। বিনোদনময়, উচ্ছ্বসিত ও সানন্দ। মেলার বড়ো একটা অংশ প্রদর্শনী। তাতে থাকে শাকসবজি, ফলফুল, শস্য, শিল্পজাত দ্রব্য, অঙ্কন ও সূচীশিল্প। প্রতিযোগিতা হয় বাইবেল পরীক্ষা আর ধর্মগীতের। ফুটবল, ভলিবল এবং স্পোর্টস প্রতিযোগিতা কয়েক দিনব্যাপী মেলার প্রধান আকর্ষণ। মেলা কমিটির স্মারকগ্রন্থে সব কিছুর মুদ্রিত হিসাব-নিকাশ পাওয়া যায়। গত বছর মেলার খরচ হয়েছে ৫৭,৯৯২•৫০ টাকা। নিপুণ সংগঠন।

মেলা প্রাঙ্গণ পাশে রেখে রাস্তা ধরে চার্চের সামনে দাঁড়াই। চার্চের প্রতিষ্ঠা ১৮৪১ সালের ৩১ মার্চ। অর্থাৎ ঠিক ১৫৪ বছর পরে দাঁড়িয়ে দেখছি খ্রিস্টীয় ধর্ম প্রচারকদের অদৃশ্য উপস্থিতি। নিম্নবর্গের কত অবহেলিত বঞ্চিত মানুষ এখানে এত বছর ধরে পাচ্ছে স্বীকৃতি আর পা-রাখার মাটি। সংস্কৃতির চলমানতা দেখছি কীর্তনের পরম্পরায়। বিদেশি পাদ্রিরা এসে যে-মেলার প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে গিয়েছেন তার তেল আর সলতের টান পড়েনি। কিন্তু প্রভাতরঞ্জন বিশ্বাস একটু নিরাশার সুরে তাঁর নিবন্ধের শেষে সিদ্ধান্ত করে লিখেছেন:
হিন্দিবলয়ের আকর্ষণীয় প্রভাবে নদীয়ার কীর্তন, পালাগান আজ অতীতের বিষয়, যা ছিল মেলার প্যাণ্ডেলের মূল আকর্ষণ। নতুন প্রজন্ম তথাকথিত ধর্মীয় কীর্তন, পালাগানে আর সাড়া দেয় না। সমাজজীবনে বহু নতুনতর আকর্ষণ থাকায় মেলার ধর্মসভাকে আর পূর্বের ন্যায় কেউ গুরুত্ব দেন না। যার উপর ভিত্তি করে মেলা প্রতিষ্ঠিত সেই ধর্মচেতনা আজ বিলুপ্তির পথে। মি. চার্লটনের নদীয়া আজ স্মৃতিকথা ।
বর্তমান মেলা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল নরনারীর এক মিলনক্ষেত্র। বৎসরান্তে প্রবাসীরা ফিরে আসে গ্রামে, আর মহামিলনক্ষেত্র মেলায় চলে মিলনোৎসব, যার রূপ গন্ধ রস বর্ণ ছড়িয়ে থাকে মেলার রেস্তোরাঁতে, মিষ্টির দোকানে, ইলেকট্রিক নাগরদোলায় বা খেলার মাঠে।

বড়োদিনে প্রভু যিশুর সামনে বাতিদানের জন্য ভক্তদের ভিড়

এ মন্তব্য থেকে আমরা কী বুঝব? চাপড়ার মেলা খুলে ফেলছে নাকি ক্রমশ তার ধর্মীয়তা, মিলে যাচ্ছে বৃহত্তর মানবমিলন কামনায়? সেটাই তো প্রার্থিত প্রসারণ।
প্রসারণের পরিসীমা কতদূর চলে গেছে সেটা বুঝলাম বাউল গায়ক শামিয়েল মণ্ডলের গানে। খ্রিস্টীয় পল্লির মাঝখানে নিজের ভিটেয় থাকেন শামিয়েল। মাঝে মাঝে গান শোনাতে ডাক আসে নানারকম বাউল-ফকিরের আসরে। ক্রিশ্চিয়ান বাউল? কথাটার মধ্যে স্ববিরোধ আছে। জন্মের পরে ব্যাপ্তাইজিত [য.] এক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী কী করে আবার লোকায়ত ধর্মে পুনর্দীক্ষিত হবে? সে কি মূলধর্মকে লঙ্ঘন করা নয়? প্রত্যয়ী স্বভাবের শামিয়েলকে সে-কথা শুধোতে তিনি বলেন, ‘দীক্ষা শিক্ষার কি শেষ আছে? আমি তাই একজন মুসলিম ফকিরের কাছে দীক্ষা নিয়েছি। যুক্তিও আছে আমার।’
–কী সেই যুক্তি?
–ঈশ্বরপুত্র যিশু যখন মানুষ হয়ে জন্মালেন পৃথিবীতে তখন তাঁরও তো দীক্ষাস্নান নিতে হল। দীক্ষা নিলেন যোহনের কাছে। তবে আর আমার কী দোষ বলুন?
–মণ্ডলীতে অসুবিধা হয় না?
–হয়। কেউ কেউ পছন্দ করে না, আবার অনেকেই পছন্দ করে। এই মেলাতেই ধরুন ২৮ ডিসেম্বর গাইব বাউল গান। আমার একটা গানের দল আছে। দরকারে সারারাত খ্রিস্টমহিমা বিষয়ে পালাকীর্তন গেয়ে দিতে পারি। আমার খ্রিস্টীয় বাউল গানের ক্যাসেট আছে গোটা তিনেক।

চার্চ থেকে শোভাযাত্রা বেরিয়ে পৌঁছেছে মেলার মাঠে

আরও পড়ুন
উজ্জ্বল উদ্ধার : শতাব্দীপ্রাচীন নিবন্ধ ‘মহালয়’

আমার পক্ষে নিঃসন্দেহে এ একটা নতুন জগৎ। মেলামোচ্ছবে ঘুরছি বহুকাল। বাউল-ফকিরদের সঙ্গও কম করিনি। কিন্তু খ্রিস্টতত্ত্ব নিয়ে বাউল গান? শেষমেষ বলে বসলাম, ‘একটা সেরকম বাউল গানই নাহয় শোনালেন?’
‘তবে শুনুন বড়োদিন নিয়ে একটা বাউল গান’, শামিয়েল বললেন, ‘গানটা আমারই রচনা। শুনুন তবে—
                 যিশুখ্রিস্ট নামের ফুল ফুটেছে
                 বেথেলহেম গোশালায়
                 ফুলের গৌরবেতে জগৎ আলো
                           সুগন্ধেতে মন মাতায়॥
                 রাতনিশীথে প্রান্তরেতে রাখালগণে ছিল
                 মন-মাতানো মধুর সুরে নতুন খবর পেল
                 বীণার তারে দূতগণে বিভুগুণ গায়॥
                           দূরগগনে পণ্ডিতগণে দেখে নতুন তারা
                           দেখে তারা দিশেহারা গণনায় বসিল—
                 রাজার রাজা মহারাজা জন্মে এ ধরায়॥’

মেলার মাঠেই চলছে বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে ঝুড়ি বোনা

গানের স্মৃতি মনে ভরে চাপড়া ত্যাগ করি প্রসন্নতায়। আছে, এখনও আছে অনেক বাঙালিয়ানা। চাপড়ার আশ্চর্য খ্রিস্টীয় মেলা একটা নতুন দিশা যেন। দূরগগনে নতুন তারার মতো রহস্যময় অথচ প্রগাঢ় এক বোধ জন্ম নেয় আমার মধ্যে। সিদ্ধধনের কীর্তন আর শামিয়েলের বাউলে কোথায় একটা শিকড়ের টান খুঁজে পাই।

* সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং বই-পত্রিকার ছবি সৌজন্যে: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

রইল আরও কিছু মেলার ছবি:

চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলায় চলছে বিকিকিনি

মেলাপ্রাঙ্গণ

মেলায় অ্নুষ্ঠিত হয় যাত্রাপালাও

বড়োদিনের মেলা উপলক্ষ্যে চলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও

জমজমাট এই মেলায় বাদ পড়ে না বাঙালির প্রিয় ফুটবল প্রতিযোগিতাও

ফুটবল টুর্নামেন্টের সূচনা

মেলায় চলে স্থানীয় চাষিদের ফসলের প্রদর্শনীও

মেলার মাঠে ভেসে বেড়ায় খ্রিস্টের কীর্তন

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: চাপড়ার খ্রিস্টীয় মেলা এবং এগজিবিশন কমিটির ফেসবুক পেজ ; মেলার বিভিন্ন চিত্র তাঁদের থেকেই সংগৃহীত।

 

 

সুধীর চক্রবর্তী
সুধীর চক্রবর্তী (১৯৩৪-২০২০): প্রাবন্ধিক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক-পদে বৃত হয়েও তাঁর চর্চাক্ষেত্র কোনোদিনই একমাত্রিক ছিল না। বাংলা গান এবং লোকসংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক এই লেখকের বিভিন্ন প্রবন্ধ একাদিক্রমে আনন্দবাজার, দেশ, এক্ষণ, প্রতিক্ষণ, পরিচয়, বারোমাস এবং অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশসূত্রে পাঠকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছিল রচনার প্রসাদগুণে। গত চল্লিশ বছর যাবৎ বাংলার লৌকিক গৌণধর্মের গবেষক হিসেবে মাটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড় । ‘ধ্রুবপদ’ নামে একটি বার্ষিক সংকলনও সম্পাদনা করেছেন। একাধিক সম্মাননায় ভূষিত এই লেখকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি: ‘সাহেবধনী সম্প্রদায় তাদের গান’, ‘বলাহাড়ি সম্প্রদায় আর তাদের গান’, ‘গভীর নির্জন পথে’ , ‘গানের লীলার সেই কিনারে’, ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’, ‘সদর-মফস্বল’, ‘পঞ্চগ্রামের কড়চা’ প্রভৃতি।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
19FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!