রসনায় তৃপ্তি হয়নি এমন মানুষের দেখা পাওয়া ভার। খাবার যে শুধু মানুষের পেটে খিদে মেটানোর একমাত্র বস্তু তা কিন্তু নয়, বরং খাবার মনের খিদেও মেটায়। আধুনিক সভ্যতার মানুষই যে রসনায় তৃপ্ত হতে নতুন নতুন খাবার তৈরি করে তা কিন্তু নয়। বরং প্রাচীন যুগের মানুষরাও কিন্তু নতুন নতুন খাবার তৈরি করতেন। আধুনিক মানব সভ্যতায় নতুন নতুন রান্নার রেসিপি জানার জন্য যেমন বিভিন্ন রান্নার বই, ইউ চ্যানেল বা টিভি শো রয়েছে, মানব সভ্যতার উন্নতির ক্রমবিকাশের সময় কালে কিন্তু সেভাবে লিখিত রেসিপির কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। মানব সভ্যতার বিবর্তন হয়নি এমন জিনিস নেই বললেই চলে। সেই আদিমকাল থেকেই বিবর্তিত হতে হতে মানুষ আজ উন্নতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা থেকে শুরু করে নানান ইতিহাসবিদ বহু গবেষণায় মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস আবিষ্কার করেছেন। বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার মানুষজনের খাওয়া-দাওয়া, জীবনযাপনের ইতিহাস আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।মানব সভ্যতার বিবর্তনের বিভিন্ন নথি এবং নিদর্শন পাওয়া গেলেও এতদিন পর্যন্ত প্রাচীন সভ্যতার মানুষদের রান্নার রেসিপির কোনো লিখিত নিদর্শন মেলেনি।
আগুন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে পর্যন্ত সমস্ত কিছু কাঁচাই খেত মানুষ। আগুন আবিষ্কারের পর মানুষ প্রথম পুড়িয়ে খেতে শেখে। এরপর ক্রমশ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তারা রান্নায় মশলা এবং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহার শেখায় মানুষের রান্নার পদ্ধতিও উন্নত হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে। অতীতে খাবারের রেসিপি লিখিত আকারে নথিবদ্ধ করার কোনো চল না থাকায় তার নিদর্শন সেভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু সম্প্রতিই একটি আবিষ্কার পাল্টে দিয়েছে প্রাচীন রান্নার সম্পর্কে মানুষের ধারণা।
আরও পড়ুন
আজও যায়নি জানা আধুনিক প্রশাসনের নজর এড়িয়ে কারা এই এঁকেছিল এই বিশালাকৃতির ছবি!
সম্প্রতি তিনটি মাটির স্লেট পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় পঁয়ত্রিশটি রান্নার প্রণালী খোদাই করা হয়েছে।আমেরিকার কানেটিকাটের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে রাখা এই তিনটি স্লেট বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে জেনেছেন এই সেগুলি ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মধ্যভাগের। আক্কাদিয়ান (akkadian) ভাষায় লিখিত এই রেসিপিগুলি থেকে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিচয় পাওয়া যায়।এই স্লেটগুলিকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন রান্নার বই হিসেবে দাবী করা হচ্ছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত দ্য ওল্ডেস্ট কিউজিন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: কুকিং ইন মেসোপটেমিয়া (The Oldest Cuisine in the World: Cooking in Mesopotamia) বইতে এই স্লেটে লিখিত রান্নার রেসিপিগুলির অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা করেছেন জেন বট্টেরো (Jean Bottero) আর টেরাসা ল্যান্ডার ফাগান (Teresa Lavender Fagan)।
ভাবতে অবাক লাগলেও এ কথা সত্যি যে এত যুগ আগেও কোনো মানুষ যত্ন করে লিখেছেন রান্নার কথা।যদিও ওই শ্লেটগুলির অনেকাংশ ভেঙে যাওয়া এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য সেই রেসিপিগুলির সবকটি উদ্ধার করা যায়নি। এছাড়াও অনুদিত ওই বইটিতে জানানো হয়েছে যে, আক্কাদিয়ান ভাষার অস্পষ্টতা এবং অজানা বর্ণের কারণে প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও সেগুলো উদ্ধার করতে সমস্য দেখা দিয়েছে। এমনকী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ওই রেসিপিগুলিতে যে উপকরণ সমূহ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলিও গবেষকদের কাছে অপরিচিত। এবং সেই সঙ্গে অন্য যে উপকরণগুলিকে চিহ্নিত করা গিয়েছে সেগুলির ব্যবহার বর্তমান রান্না থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে। ফলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবে সেগুলি আসলে কী।
আরও একটি বাস্তব হল ওই উদ্ধার হওয়া ওই রেসিপিগুলির রান্নার পদ্ধতি, রান্নার সময় এবং উপকরণের পরিমানও সঠিকভাবে লেখা নেই। ফলে কেউই এই রান্নাগুলি সঠিকভাবে বুঝে বিশ্বাস করে বর্তমান সময়ে রান্না করতে পারবেন না। তবে এই অস্পষ্টতা খানিকটা সুবিধাও করে দিয়েছে রান্নাগুলিকে নতুন করে ভাবার জন্য যাতে কেউ এর অথেনটিসিটি যাচাই না করেও নিজের মতো করে রান্না করে নিতে পারেন।
তবে এই রেসিপিগুলিতে একটা জিনিস কমন আর তা হল প্রত্যেকটি রান্না করে পদেই রয়েছে মাংস, বড়ো ধরণের পাখির মাংস, শাকসবজি, এবং এসবকিছুই জলে সেদ্ধ করা। সেই সময় প্রত্যেকটি রান্নাই জল দিয়ে রান্না করা ছিল এক বিরাট আবিষ্কার। অন্যান্য প্রমাণ থেকে আমরা জানতে পারি যে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মধ্যভাগের আগে সম্পূর্ণ অন্য ধরণের রান্নার পদ্ধতি ব্যবহৃত হত। যেমন উনুনের আঁচে, গরম ছাইয়ের পরোক্ষ উত্তাপে, বা সরাসরি আগুনের শিখায় খাদ্যবস্তু পুড়িয়ে, ঝলসে বা সেঁকে নেওয়া।তবে জলকে রান্নার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা স্বাদ এবং রান্নার গুনগত মানের দিক দিয়ে এক বিশাল পদক্ষেপ ছিল বলে মনে করা হয়।রান্নায় এই জলের ব্যবহার খাবারে গুনবত্তা এবং স্বাদে এমন বৈচিত্র তৈরি করেছিল যা আগের পোড়ানো, ঝলসানো বা সেঁকা খাবারে পাওয়া যেত না।
আরও পড়ুন
শেষ সোনালি ইগল শিকারি: খাবারের সংকট দূর করতে ছ’ হাজার বছর ধরে ইগল পোষেন এই সম্প্রদায়
ওই নির্দিষ্ট তিনটি মাটির স্লেটে মাংস এবং শাকসবজির স্টু এবং স্যুপের মোট ৩৫টি রেসিপি রয়েছে। তবে কোনোটিতেই উপকরণের পরিমাণ এবং রান্নার সময়ের উল্লেখ নেই। যেমন একটি স্লেটে আমুরসানু পায়রার স্টু তৈরির যে রেসিপি এবং পদ্ধতি লেখা আছে তা হলে: “পায়রার মাংসকে দু-ভাগে ভাগ করে নিন- তাতে অন্য মাংসও যোগ করুন। এরপর জল প্রস্তুত করুন, তাতে স্বাদের জন্য চর্বি এবং নুন দিন। এরপর তাতে ব্রেডক্রাম্বস, পেঁয়াজ, সামিদু, লিক্স এবং রসুন দিন। (এই উপকরণগুলি দেওয়ার আগে প্রথমে এই সমস্ত গুল্ম বা মশলাগুলিকে দুধে ভিজিয়ে রাখুন)। যখন রান্না হয়ে যাবে তখন তা পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত”।
ইয়েলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাবিলনীয় সংগ্রহশালার কিউরেটর বেঞ্জামিন ফস্টার এই ব্যাপারে বলেন, “আমুরসানু যা সম্ভবত এক ধরণে পায়রার প্রজাতি, এবং সামিদু যা একটি অজানা মশলা, এই দুটিকে বাদ দিলে বাকি সমস্ত উপকরণগুলি অবশ্যই আমাদের চেনা। কিন্তু বাস্তবে ওই রান্নাটি হুবহু করা প্রায় অসম্ভব”। তিনি আরও বলেন যে, “যেহেতু মানুষ সাধারণত মনে করে যে তারা আরব এবং পার্সিয়ান খাবার রান্না করতে পারেন, তাই তারা সহজেই এই রান্নাটি করে ফেলতে পারবে্ন। কিন্তু তারা এটা জানেন না যে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তারের ফলে এই আঞ্চলিক রান্নাগুলি কতটা পরিবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু আপনি যদি পুরোনো উপকরণগুলির বদলে তার প্রায় কাছাকাছি আধুনিক প্রাচ্যের উপকরণ ব্যবহার করে ওই রান্নাগুলি করেন তা হলে অবশ্যই একটা কল্পনা হয়ে দাঁড়াবে, তবে আপনার করা রান্নাটি হয়ত সুস্বাদু হতে পারে”।
তাই আপনিও যদি ব্যাবিলনীয় এই রেসিপি ব্যবহার করে রান্না করতে চান প্রাচ্যের উপকরণ ব্যবহার করে, তাহলে কে বলতে পারে প্রাচীন এই রান্নার মতো না হলেও আপনি নিজেই বানিয়ে ফেলতে পারেন এক সুস্বাদু রান্নার পদ।
দেখে নিন কীভাবে রাঁধবেন ৪০০০ বছরের প্রাচীন ব্যাবিলনীয় রান্না
উদ্ধার করা আরও কিছু প্রাচীন ব্যাবিলনীয় রান্নার রেসিপি দেওয়া হলো ভিন্নসময়ের পাঠকদের জন্য:
Recipe for pašrūtum “Unwinding”
Recipe for m. puhādi “Stew of Lamb”
Recipe for m. elamūtum “Elamite Broth”
Recipe for “Tuh’u”