২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

২৬ অক্টোবর, ২০২১মঙ্গলবার

ঠাকুমা আমায় দেখতে শিখিয়েছিল একটা পাতার শিরা কেমন দপদপ করা জীবন্ত

বাবার আর মায়ের বাড়ির লোকজনই ছিল আগের পর্বে লিভ উলমানের মূল আলোচ্য। সম্পন্ন পারিবারিক কুটুম্বিতা সত্ত্বেও অভিনয়ের জগতে এসে পিতৃকুলের আত্মীয়দের কাছে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়ার কথাও বলেছেন। নাট্যাভিনয় ছাড়াও, প্রথম ছবিতে এক জঙ্গলের ঝরনায় নামজাদা উলমান বংশের মেয়ের অনাবৃত স্নানদৃশ্যই হয়তো তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। পাশাপাশি স্মৃতির উজানে এসেছে তাঁর মায়ের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ছোটোবেলায় ঘনিষ্ঠতার কথাও। মা আর দিদিকে ঘিরে আপন অনুভূতির চিহ্নও সেখানে ছিল যেমন। আর সেইসঙ্গে পোষ্য মার্জারের বৃত্তান্তও। এবারে প্রসঙ্গ তাঁর ঠাকুমা, তাঁকে কেন্দ্র করেই স্মৃতির বিস্তার। এখানেই কথা সূত্রে তিনি কবুল করেছেন, ‘যখন আমার বয়েস সতেরো, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর বয়েস ছিল তখন পঁচাত্তর।’ কবি-অনুবাদক সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর তরজমায় ভিন্নসময়-এর পাঠকদের জন্য এবার সেই স্মৃতিলেখা পৌঁছোল নবম পর্যায়ে।

 

বৃদ্ধাবাস

বাবা যতদিন বেঁচেছিল, ঠাকুমা আমাদের সঙ্গে থাকত।
এক বৃদ্ধা মহিলা, যার মনটা কিশোরীর, যে মনে করত আমরা একই গোত্রের দুই আত্মা, আর তাই মন খুলে দিত আমার কাছে।
এই পৃথিবীটাকে ঠাকুমা নতুন করে গড়েছিল, যেখানে যা-খুশি তা-ই হতে পারে। যেখানে আমরা চোখ দিয়ে একটা গাছ বা একটা পাথরকে যেমন দেখি, আসলে তারা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ঠাকুমা আমায় দেখতে শিখিয়েছিল একটা পাতার শিরা কেমন দপদপ করা জীবন্ত। ঠাকুমাই আমায় প্রথম বলেছিল গাছকে আঘাত করলে তারা কীরকম কাঁদে।
আমরা যখন হাঁটতে বেরোতাম, প্রকৃতি হয়ে উঠত স্বর্গের একটা টুকরো, যেখান থেকে ঈশ্বর তাঁর মেঘ, সূর্য আর তারাদের পর্দা সরিয়ে দৃষ্টিপাত করেন।

 

যা-কিছুই জন্মাচ্ছে, তার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য, নিজস্ব জীবন রয়েছে। আমরা কখনো কোনো সংরক্ষণ নিয়ে কথা বলিনি; কিন্তু ঠাকুমা আমায় শিখিয়েছিল প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব করার, তাকে নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই। আমিই যেন এই সব কিছুর দায় বইছি।

 

ভারী ভারী নাক-চোখ আর অজস্র বলিরেখায় ভরা একটা মুখ। দু-চোখের সাদা অংশটা পীতাভ হয়ে এসেছে, কিন্তু মণিদুটো এখনও অপরূপ হালকা নীল। যার বুকে মাথা গুঁজলে একটা সুবাস পাওয়া যায়। জড়িয়ে ধরলে ওম।

আরও পড়ুন
প্রথম ছবি ‘ইয়ং এসকেপ’এর প্রিমিয়ারে আমার এক খুড়োদাদু পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে জানতে চান ওই সিনেমার শো বন্ধ করা যায় কি না

আমার বয়েস সতেরো, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর বয়েস পঁচাত্তর

বড়ো হয়েই বুঝলাম, ঠাকুমা ছিলেন বুড়োমানুষ। খেয়াল হল, যে-পিঠ ধরে ঝুলতাম, সেটা ছিল বাঁকানো, নুয়ে-পড়া। যে-চুল নিয়ে ঠাকুমার ভারী গর্ব ছিল— ছোটোবেলায় ছেলেরা কেমন সেই চুল ধরে টানতে চাইত— তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা শীর্ণ সাদা পিগটেল, যেটাকে মাথার পেছনে পেঁচিয়ে ছোট্টো খোঁপা করে রাখা হত।

 

আমরা থাকতাম ট্রোন্ডহাইমে, ঠাকুমা অসলোয়। কিন্তু গ্রীষ্মকালগুলো আমি প্রায়ই তাঁর কাছে গিয়ে কাটাতাম। আমার যখন সতেরো বছর বয়েস, বছর খানেকের জন্যে অসলোয় থাকতে গেলাম। কখনো কখনো আমরা একসন্ধেয় তিনটে সিনেমা দেখতাম। টিকিটের দাম দিতেন ঠাকুমা। ছোটো ছোটো সব কাফেতে যেতাম আর কথা বলতাম চারপাশের মানুষজনদের নিয়ে।

 

সবচেয়ে ভালো ছিল রাত্তিরে ওঁর ঘরে থাকতে পারা। ঠাকুমার বাড়িওয়ালি অতিথিদের থাকার অনুমতি দিতেন না বলে চুপচাপ থাকতে হত আমাদের।
জানলার ধারের ডেস্কটা। চিঠিপত্র, বাক্স, গয়নাগাটি, আরও কত কী। অমন রোমাঞ্চকর ডেস্ক আর কারও দেখিনি। দীর্ঘ একটা জীবনের স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।

আরও পড়ুন
কোথায় যেন পড়েছিল কোনো বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের পক্ষে যৌন অভিজ্ঞতা না-থাকাটা ক্ষতিকর


মাঝে মাঝে ঠাকুমার সব প্রেমপত্র পড়ে আমরা কান্নাকাটি করতাম।
ঠাকুরদা মারা যাওয়ার অনেকবছর আগেই ওঁদের বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। সবাই বলাবলি করত ঠাকুমা অমন জেদি আর মন্দ বলেই ঠাকুরদা ওঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। আমি কিছুতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম না। আমরা ঠাকুমার বিছানার সোনালি চাদরের ওপর বসে বুককেসের ওপর ঠাকুরদার ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর চোখ সরাতাম বাবার ছবিতে। ঠাকুমা যখন এক অফিসারের তরুণী স্ত্রী আর বাবা ছোট্টো একটা ছেলে— যার মতো লক্ষ্মী ছেলে পৃথিবীতে আর একটাও নেই— সেই গল্প শোনানোর সময় তাঁর গলার আওয়াজ! ঠাকুরদা তাঁর অপূর্ব ইউনিফর্ম পরে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে একে একে দু-জনকে উঁচুতে তুলে ধরতেন।

 

ঠাকুমার অসুখী দাম্পত্য। এমন একটা বিচ্ছেদ, যার জন্যে তাঁকে দায়ী করা হত, অথচ ঠাকুরদাই কিন্তু তৎক্ষণাৎ আরেকটা বিয়ে করে ফেলেন। আমি কখনো ঠাকুমার কাছে জানতে চাইনি আসলে কী হয়েছিল। জানতাম, তাঁর শুধু সুখের দিনগুলোই মনে রয়েছে। যতদিন ধরে ঠাকুমাকে দেখেছি, তিনি বেঁচে এসেছেন একটা কল্পপৃথিবীতে, যা তাঁর কাছে সমস্ত অসুখী স্মৃতির চেয়ে বশি বাস্তব। তাঁর সেই পৃথিবীতে আমরা দু-জন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াতাম।
অসলোতে, যখন আমার বয়েস সতেরো, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর বয়েস ছিল তখন পঁচাত্তর।

আরও পড়ুন
আমি ছুটছি আরেক জগতের দিকে, যাকে আমি সবসময় স্বীকার করি না

বৃদ্ধাশ্রমিকার সঙ্গে আপনজন

ওঁর জীবনের শেষদিনগুলোর কথা ভাবলে কষ্ট হয়। একটা বৃদ্ধাশ্রম। সুন্দর সাজানো। সমস্ত রং সামঞ্জস্যপূর্ণ, কর্মীরা উপস্থিত সাদা অ্যাপ্রন আর ধৈর্যশীল হাসি নিয়ে। কিন্তু যখনই ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা সাপারের ঘণ্টা বাজে, পঞ্চাশ জন বৃদ্ধাকে তক্ষুনি নিজেদের ঘর ছেড়ে খাওয়ার ঘরে জড়ো হতে হয়। যাঁদের সঙ্গ তাঁরা চাননি, টেবিলে তাঁদের পাশেই বসতে হয়। যেসব বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই, তা নিয়েই কথা বলতে হয়। একাকিত্ব আর অপেক্ষাই যাঁদের মধ্যে একমাত্র মিল, তাঁদের ভেতর থেকেই বন্ধু খুঁজে নিতে হয়।

 

কোনোদিন যদি শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হয়, সেই ভয়। তিন দিন বিছানায় কাটানোর মানে নার্সিংহোম বিভাগে বদলি হওয়া। ঘর পাওয়ার জন্যে দীর্ঘ লাইন লেগে থাকে আর নার্সিংহোম থেকে খুব কমজনই ঘরে ফিরতে পারে। ঠাকুমাকেও তো একদিন সেখানেই যেতে হবে!

‘বৃদ্ধবয়েসে সারাক্ষণ নজরে নজরে থাকাটাই তো ভালো, নিজের মতো লোকজনের সঙ্গে।’ যেসব পরিজনরা তাদের কাছের মানুষের ভালোই চায় আর পাঠিয়ে দেয় এমন একটা জায়গায়, যেখানে কেউ আর ‘আমি’ থাকে না, হয়ে ওঠে ‘আমরা’।
‘আমাদের’ হয়তো একটু তাড়াতাড়ি শুতে যেতে হয়— যাতে ‘আমরা’ পরের দিন উঠে বসার অবস্থায় থাকি। কখনো কখনো রাতের পরিচ্ছন্নতা আর শুতে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় বিকেল চারটে বাজতে-না-বাজতেই। একটু আগে আগেই হয়তো, কিন্তু পরিচারকরা তো সংখ্যায় বেশি নয়— আর ‘আমরা’ জেগে থাকলেও তো ‘আমাদের’ তেমন-কিছু করার থাকে না।

আরও পড়ুন
তারপর ঠিক করলাম শুধু ওঁকে দেখানোর জন্যেই আমি হয়ে উঠব এক শিশুপ্রতিভা

পথের শেষ কোথায়

দরজায় টোকা দেওয়ার দরকার পড়ে না আর। একজন বুড়োমানুষের আর কী এমন গোপনীয়তা থাকতে পারে? যার বিছানা আরেক জনের চেয়ে মাত্রই তিন ফুট দূরে? যেখানে নেই কোনো বই বা ছবি বা আসবাব। এটাই নিয়ম। তবে যদি নার্সমহিলাটি একটু সদয় প্রকৃতির হন, ‘আমরা’ হয়তো দেওয়ালে একটা ছবি টাঙাতে পারি। (তবে পেরেক না ঠোকাই ভালো, ওতে বিশ্রী দাগ হয়ে যায়।) তাতে করে ‘আমরা’ শুয়ে শুয়ে পরিবারের, বন্ধুদের মুখগুলো দেখতে পারি, যাদের নিজেদের জীবনে এত ব্যস্ততা যে, বুড়োদের দেখতে আসাটা সপ্তাহের পর সপ্তাহ পিছিয়ে যায়। যতই হোক, ‘আমরা’ আরামেই তো আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় লোকজনের দেখা করতে আসা মানেই ঝামেলা।

মনে পড়ে, ঠাকুমা আমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। টেলিভিশন-ক্যাবিনেটের দরজা খুলে উনি অবাক হয়ে গেলেন, ভেতরের চমৎকার মেয়েটি গেল কোথায়। বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না যে, ঠাকুমার ভিমরতি ধরেছে, বিভ্রম থেকে ওঁকে বের করে আনতে চাইছিলাম। বলতে চাইছিলাম, উনি যেন স্থবির না হয়ে পড়েন। মনে করাতে চাইছিলাম, আমি ওঁকে ভালোবাসি, আগেকার মতোই সব ভাগ করে নিতে চাই। উনি যে-জীবনটার এক সমৃদ্ধ অংশ ছিলেন,মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এখন আর উনি তাতে জুড়ে নেই।

 

বিছানার পাশে বসে আমি ঠাকুমার প্রতিবেশিনীর দিকে সন্ত্রস্তভাবে তাকালাম। উনি শুয়ে রয়েছেন, অনেকদিন আগেই ঢূকে পড়েছেন সেই জগতে, যেখানে একজন শান্তিতে স্বপ্ন দেখতে আর স্মৃতিতে ডুবে থাকতে পারে।
কী বলব ভেবে না পেয়ে আমি ঠাকুমার হাতটা ধরে রইলাম। জানি, সহবাসিনীকে অনুসরণ করে শিগ্‌গিরই উনিও ওই স্বপ্নের দেশে চলে যাবেন। যে-পরিস্থিতিতে রয়েছেন, তা ওঁর সহ্যের অতীত।

আরও পড়ুন
একটা বই লেখার চেষ্টা মাত্র আমার সাংসারিক দায়িত্বপালনের অক্ষমতাকে পুষিয়ে দেয় না

বৃদ্ধাশ্রম, সুন্দর সাজানো, কর্মীরা উপস্থিত ধৈর্যশীল হাসি নিয়ে

জীবনের সেই মুহূর্তে উনি পৌঁছে গেছেন, যেখানে শেষপর্যন্ত একজনকে উত্তরের খাতায় উঁকি দিতে দেওয়া হয়। আর, কোনো উত্তরই থাকে না।

 

উনি যেমন চান, জীবন আর কখনোই তেমন হবে না। শেষটুকু আসবে অন্য সব কিছুর চেয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে। ঠাকুমাকে দেখতে গেলে উনি জিজ্ঞেস করতেন, আমি কে। যেন আমার ছোটোবেলায় আমরা একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরিনি। উনি আর জানেন না যে, একদিন দু-জনে আশ্চর্য সব গোপনকথা বিনিময় করতাম।
আমি ওঁকে দেখতে যাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিলাম।

ঠাকুমা মারা গেলেন। কিছুই আর আগের মতো রইল না।
যে অনেক আগেই চলে যাবে, তেমন কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটা হয়তো মূর্খামি মাত্র।

(পরবর্তী অংশ আগামী শনিবার)

সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি ও অনুবাদক। অবসরপ্রাপ্ত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: অবিদ্যা, বসন্তপ্রকৃতি, আরব্য উপন্যাসের মেয়ে বা মেয়েদের ব্রতকথা, ঠাকুরমার ঝুলির ভূমিকা, নীলবেগুনি শরীরের দেবী, কাজলরেখার বাড়ি প্রভৃতি। সম্মাননা: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক পুরস্কার (১৯৯৬), কৃত্তিবাস পুরস্কার (২০০১), পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির অনীতা-সুনীলকুমার বসু স্মারক পুরস্কার (২০০১), রবীন্দ্র পুরস্কার (২০১৮)।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

7,808FansLike
19FollowersFollow

Latest Articles

error: Content is protected !!